এবং একটি মৃত্যুর গল্প!

জলিলের ডাকা হরতাল এবং একটি মৃত্যুর গল্প!
০৬ ই এপ্রিল, ২০০৯ সন্ধ্যা ৬:২৮
ছোটবেলা থেকে ছেলেটি ভীষণ অভিমানী। একটুতেই জেদ হয়। খেতে বসে দেখা গেলো সেদিন তার প্রিয় ব্যঞ্জন যুক্ত হয়নি, অমনি গাল ফুলিয়ে খাবার প্লেট ছুঁড়ে ইঠে যায়... অনেক সেধে সেধে মা, মার এর বাবা- সবাই তোয়াজ-তোষামোদ করে আবার হয়ত খেতে বসালো।... ...এই ছেলেটি একসময় বড় হয়। বুদ্ধি হয়। তখন কতো দাবি তার কাছে তার বাবা মার! তোমাকে ানেক বড় হতে হবে! শিতি হতে হবে, আমাদের মুখ উজ্জল করতে হবে।. . . . . .স্কুলে ভালো রজোল্ট করতে কতো পরিশ্রম তার। এই এক স্যার পড়িয়ে যাচ্ছেন তো আরেক স্যার পড়াবার জন্য হাজির। সারাদিন পড়া আর পড়া। বই নিয়ে বসে থাকতে থাকতে বিরক্ত ধরে যায়। বড়রা তখন তাকে মাঝে মাঝে একটু মাঠে যাবার, খেলতে যাবার, ঘুরতে যাবার সুযোগ দেয়। বড়রা তাদের বড় বড় সব স্বপ্নগুলো পূরণ করাতে সারাদিন লেগে থাকে ওর পেছনে।বাবা অফিস থেকে সকাল সকাল ফিরতে চান। ছেলেটি একা, ওর মা হয়ত কাজে ব্যস্ত। ছেলের দিকে হয়ত ভালোভাবে নজর দিতে পারছে না। বাবা চান বাড়তি কেয়ার নিতে।এভাবেই বড় হয়, বড় হতে থাকে সে। যতো বড় হয় ততো বেশি নজরে আসতে থাকে মানুষের। বন্ধুদের, প্রতিবেশীদের, আত্মীয়-স্বজনদের। অমুক বলে ভাই আপনার ছেলেকে নিয়ে আসবেন কিন্তু, তমুক বলে ভাবী বাসায় আসেন না আপনার ছেলেকে নিয়ে!. . . . . . . কিন্তু সময়টা স্থির হয় না। কেবলই ছুটতে থাকে, ছুটতেই থাকে অনন্তের দিকে. . . . স্কুল পেরিয়ে কলেজে পা দেয়। স্কুলজীবনের স্মৃতি, প্রতিবেশী-আত্মীয়-বড়দের স্নেহের স্মৃতি পীড়িত করে তাকে। অভিমানী চেলে ভাবে নিজেও সবাইকে ভুলে যাবে।. . . দেখবে তাকে কারও মনে পড়ে কি না।. . . সেই আন্টির, যে তাকে হাজারও চুমু খেতো, সেই ভাইয়ার যে তাকে আবৃত্তি শেখাতো, সেই দাদুর যে তাকে গান শেখাতো আর কেশে উঠতো খুকখুক।কেউ কেউ মনে করে খোঁজ নিত, ফোন দিত, কেউ কেউ তা করত না। এভাবে গবীর স্মৃতির অনেক মানুষই ধীরে ধীরে হারিয়ে যায় স্মৃতিপট থেকে। কিন্তু যখনই মনে হয় ছেলেবেলার কথা! তখনই বুকের ভেতরটা যেন কেমন করে ওঠে। ভাবে একদিন অনেক বড় হয়ে, অনেক সম্মানী-দামি কেউ হয়ে সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে হানা দেবে চমকে দেবে. . . . .সেই আশায় সে বড় হতে থাকে।. . . .এবার সে ভর্তি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। ভর্তি পরীা দিতে গিয়ে একবেলা খেতে হয়েচিল হল ডাইনিংএ। ডালের হাল দেখে তার বেহাল অবস্থা। বড়ভাইরা বলে, আগের চে একটু ডেভলপ হইছে, কউে বলে চালাও একটু কষ্ট করে, পরে অভ্যস্ত হয়ে যাবা. . . . . . অভ্যস্ত সে হয়েছিল। শুধু শরীরটা ঠিক ফিট করতে চায় না। এই সমস্যা সেই সমস্যা.. . . .বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিক্যাল সার্ভিসের সস্তা ঔষধে সুস্থও হয়! শুধু. . . . বি.বি.এ ইন অ্যাকাউন্টিং এর ছাত্র সে। বাড়ির- পরিবারের আদরের ডাকটি বন্ধুরাও একসময় জেনে যায়। বাবু। শফিউদ্দিন বাবু। কেউ ডাকে শফি, কেউ ডাকে বাবু। স্কুলে সবার মাঝে পরিচিতি- সুনাম থাকলেও এখানে সেটা সম্ভব হয়ে উঠছে না। বিশ্ববিদ্যালয় তো যেন বিশ্বের সেরা সেরা সব প্রতিভাবানরা ছুটে আসে এখানে। ভর্তি হয়। তাদের মাঝে ওইটুকু প্রতিভা দিয়ে খুব বড় যায়গা দখলকরা না গেলেও একটা বন্ধু-ভক্ত- পরিচিতি পরিমণ্ডল ঠিকই গড়ে উঠলো। তবে এখানে বিশেষ মর্যাদার আসনটি পাওয়া যায় একটু ভালো রেজাল্ট করতে পারলে, সিরিয়ল এ আসতে পারলে। এই যেমন লিপু ভাই আর লাবনী আপু, এঁদের সবাই চেনে, সম্মান করে, তোয়াজ-সমীহ করে। জুনিয়ররা খাতির করার চেষ্টা করে; পরামর্শ আর নোটের জন্য ঘুরঘুর করে। বুবুরও খুব ইচ্ছা সিরিয়ালে আসা। এখন তার নিরন্তর চেষ্টা একান্ত নিজের। বাবা মা’র শাসন নেই, টিচারদের ভয়-চোখরাঙানী নেই তবু পড়া আর পড়া।. . . . . টিউটোরিয়াল পরীায় এ গ্রেড পেয়ে সবাইকে চমকে দেয় সে। কম্পিটেন্টরা ঈষা করে। দূর দিয়ে চলে। মেশা বন্ধ করে। দূর্বলরা খাতির পাকিয়ে কিছু ডোজ পেতে চায়। সবল গতে চায়। সবই চলে নিয়মমত। শুধু শরীরটাই যেন পেরে ওঠে না পুরোপুরি। ডাক্তার দেখায়, ভালো হয়, আবার কদিন পর যেই সেই। খেতে পারে না, বমি বমি লাগে, সবকিছুতে কেমন গন্ধ গন্ধ লাগে!. . . .ডাক্তাররা এবার ভালোভাবে পরীা-নিরীা করে। ব্লাড টেস্ট, স্টুল, কফ ইত্যাদি প্যাথলজিক্যাল টেস্ট করে জানতে পারে সেই খবর! ভয়বহ রোগের খবর! হেপাটাইটিস বি ভাইরাস। ডাক্তার বলে রেস্টে থাকতে। কিন্তু বাবুর তখন পড়ার নেশা। প্রবল নেশা ফার্স্ট হওয়ার। ভেঙে পড়তে চায় না রোগের কাছে। বিকেলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় মেতে থাকতে চায়। গিটার বাদক বন্ধু রাজিবের মিউজিক শোনে বঙ্গবন্ধু হলের পুকুর পাড়ে বসে।অবস্থার আরও অবনতি হলে বাবা আসেন ছেলেকে বাড়িতে নিয়ে যেতে। ছেলে যেতে চায় না। পরীা কাছাকাছি চলে এসেছে। এখনও পড়া অনেক বাকি।. . . .বাবার জ্বোরের কাছে, বন্ধুদের আশ্বাসে বাবু বাড়ি যায়। বন্ধুরা তাদের কথা রাখে। কাসনোট পাঠায় ওর নামে। খোঁজ-খবর নেয়- বলে তুই রেস্ট নে, সুস্থ না হয়ে আসার দরকার নেই, প্রয়োজনে আমরা পরীা পিছিয়ে দেবো।. . . এই অসুখের সবচে বড় টনিক হলো রেস্ট। রেস্ট পেয়ে বিলিরুবিন এর মাত্রা যথাস্থানে নেমে আসছিল, বাবুও সুস্থবোধ করছিল। ওকে ছাড়া ওর বন্ধুরা পরীায় অংশগ্রহণ করবে না। ও ফিরে আসে হলে। ঠিক ডেটেই পরীা হবে, বাবু পরীা দিয়ে রেস্টে যাবে। কিন্তু অনিবার্য কারণে রাজনৈতিক নেতার আনুগত্য করতে স্বগোত্রীয় শিকরা আন্দোলনের নামে কাস-পরীাবর্জনসহ নানা কর্মসূচি-আল্টিমেটাম ঘোষণা করে। পরীা স্থগিত হয় অনির্দিষ্টকালের জন্য। এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের মামুলি ঘটনা। যদি সময়মত পরীা হত তাহলে ৪বছরের কোর্স শেষ হতে ৭-৮বছর লাগত না। বাবা আবার বাড়ি চলে যায়। ওর রেস্ট দরকার।কিন্তু কে জানতো ১ মাস পরই আবার পরীক্ষার ডেট ঘোষণা করবে পরীা কমিটির এবং ডিপার্টমেন্ট এর চেয়ারম্যান!বাবুর শারীরিক অবস্থা তখন খুবই নাজুক। ও কোনওভাবেই পরীায় অংশগ্রহণ করার মতো ফিট নয়। অনেক ডাক্তার, অনেক শিক, অনেক ছাত্রনেতার দ্বারস্থ হন ওর বাবা।কিন্তু চেয়ারম্যানের একই কথা, পরীা তিনি পিছাবেন না। বিগত দিনে এরকম রুরি ভুরি নজির থাকলেও সেটা মানতে তিনি নারাজ। ছাত্রনেতারা অনুরোধ করে কিন্তু তাতে ফল হয় উল্টো। নিজদলীয় ছাত্রনেতা তারা নয় যেহেতু সেহেতু তাদের এমন দাবি করা সন্ত্রাসের শামিল। নিজদলীয় ছাত্রনেতারা যদি বোনের বিয়ে উপল্েয পরীা পেছান সেটা কিন্তু সম্ভব।কোনওভাবেই পরীা যখন পেছানো গেলো না, তখন সবাই সিদ্ধান্ত নিল যে তারাই পরীা দেবে না। স্যাররা নেবে কী করে! কেউ কেউ আমতা আমতা করে পরে ঠিকই রাজি হলো পরীা তারা দেবে না। এক সহপাঠীর জীবনের জন্য তারা একমাস -দুইমাস পিছিয়েপরতে রাজি। কিন্তু ছাত্র তো ছাত্রই, তাদের শিকরা আরও বেশি রাজনীতি জানেন; তারা নিজের দলের কর্মী-সমর্থকদের খুঁজে বের করলেন, যেসব সহকর্মী শিক পরীা নেয়ার পে না তাদের সরিয়ে নিজের দলের টিচারদের দিয়ে নিজের দলের কর্মীদের পরীক্ষা নিলেন। মাত্র তিনজন তাতে অংশ নিল। বাকিরা তাদের কর্মসূচিতে অটল থাকল। এবং নিজেদের সর্বনাশের কথা ভেবে হাহাকারে ভরে উঠলো সবার মন। কে দেখে তাদের বুকফাঁটা কান্না।বাবুর বাবা মা বলেন ছেলে একবছর পর পরীা দিক। কিন্তু কেই বা চায় জীবন থেকে একটি বছর হারাতে? সময়ের মূল্য যেন জীবনের চে বেশি।এদিকে প্রচণ্ড অভিমান জমে বাবুর বুকে। টিচাররা ক্রুর! ঠিক আছে পরীা আমি দেবোই। পরের কোর্সের প্রস্তুতি নেয় সে। শরীর কোনওভাবেই সাপোর্ট দেয় না। চোখ মুখ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে যায়। তবু পরের পরীায় অংশ নেয় বাবু। বন্ধুরা ওর জন্য একটা পরীা মিস করলো; বন্ধুদের এই আত্মত্যাগে ভীষণ লজ্জিত হয়, কৃতজ্ঞ হয়। বন্ধুরা এক কোর্সেন আশঙ্কা নিয়েই খুশি মনে পরীার হলে ঢোকে। পরীা দিয়ে বাবু বাড়ি যায়। আবার পরের পরীা দিতে ওর বাবা নিয়ে আসে। ৩টি পরীা শেষ হয়। এরপরের পরীায় আর বাবুকে পাওয়া যায় না। বন্ধুরা বেশ চিন্তিত হয়। ভাবে অসুস্থতা বেড়েছে। বাবুর বাবা জানায় হ্যাঁ একটু বেড়েছে, তবে এখন সে ভালোই আছে, তোমরা পরীা শেষকরে ওকে দেখতে এসো, ও খুব খুশি হবে. . . . . পরীা শেষে ওরা জানতে পারে বাবু আসলে অনেক আগেই চলেগেছে। পৃথিবীর এই মেকি পরীার আসর ছেড়ে প্রভূর আসল পরীাগারে! বন্ধুরা কান্নায় ফেটে পড়ে।কিন্তু কিছুই করার থাকে না।ভিসির কাছে হলপ্রোভোস্টের মাধ্যমে আবেদনকরে বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ি ম্যানেজ করে সদলবলে দেখতে যায় প্রিয় বন্ধু বাবু কে। তাদের অশ্র“ আর কান্নার শব্দে আবার একবার জেগে ওঠে বাবুর কবর!. . . . . বাবুর বাবা এতগুলো ছেলেমেয়েকে একসঙ্গে পেয়ে তার শোক যেন আরও উথলে ওঠে। বলে তোমরাই আমার সন্তান। আমার বাবু। যারা আমার ছেলের জন্য নিজেদের জীবন বাজি রাখতে পারে তারাই আমার সন্তান।. . . .এক শিকের মানবিকবোধের অভাবে এমন কত অঘটনই ঘটে যা আমাদের অজানা।. . . .এখনও ওর বন্ধুরা চষে বেড়ায় সেই ক্যাম্পাস। আড্ডা দেয় মাঠে, ফ্যাকাল্টিতে, লাইব্রেরিতে। এখনও পুকুরপাড়ে এসে বসে একলা রাজিব; কেমন করে যেন বেজে ওঠে ওর গিটারে সেই গান।“ও বন্ধু তোকে মিস করছি ভীষণতোকে ছাড়া কোনও কিছূ আর জমে না”. . . পার্থবড়–য়াকারও কণ্ঠে শোনা যেত আপে.. ..বন্ধু তুমি ফিরে এসো. . . . বাপ্পা

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.