সব কিছু ভেঙ্গে পড়ে...


১৯ শে নভেম্বর, ২০০৮ সকাল ১০:০৮

শেয়ার করুনঃ
0 00

নব্বুই বা একানব্বুইয়ে এক বছরের জন্য আমি ঢাকায় পড়তে এসেছিলাম।
তখন সিক্সে, আর আমি থাকতাম হোস্টেলে।
আমরা, পদ্মার ওপারের গৃহকাতররা তখনও এপারে আসা শুরু করিনি এখনকার মত।
হোস্টেলে সবচে' ছোটদের তালিকায় আমি ছিলাম প্রথম দিকে।
তিন চারশ ছেলের মধ্যে নামের আগে পুচ্চি উপসর্গ লাগিয়ে পুরো হোস্টেলে আমি এক নামে পরিচিত,
সবার আদরে আদরে আমার দিন কাটছে, কিন্তু হোস্টেলের এই সেমি বন্দী জীবন আমার ভাল লাগেনা।
থেকে থেকে শুধু কপোতাক্ষ'র পানিতে ট্রলারের পেছনে ছোটা, চৈত্রর লম্বা দুরন্তু দুপুরে গুলতি হাতে দল বেধে হলুদ পাখির খোঁজে খেজুর বনে হারানো
আর বিকেলে দাঁড়িয়া বান্ধা, গোল্লা ছুটের মোহ ছড়ানো স্মৃতি
আমাকে কাবু করে দেয়।

এই অবেলার দিনে একদিন আমার চেয়ে তিন ক্লাস উপরে পড়া একটা ছেলে পুরোনো সব বাঁধন ভাংতে শেখাল প্রথম আর আমিও হতে শুরু করলাম পৃথিবীর যাত্রী।

ভাল গাইতে পারে, ভাল ডিবেট করতে পারে, ভালো আঁকতে পারে,
খেলা ধুলায় ভাল এমনকি ছাত্র হিসেবেও সে প্রথম।
সৃষ্টিশীল শিল্পকলার সবগুলো শাখায় সমান দক্ষতা নিয়ে মাত্র নাইনে থাকাবস্থায়ই সে ছাত্র শিক্ষক সবার কাছেই নিজের উপযুক্ত অবস্থান করে নিয়েছিল।
সেই ছেলেই আমাকে ছায়া দিয়ে রেখেছিল অনেক অনেকদিন,
এক বছর বাদে আবার যশোর ফিরে আসার পরও।
আমার সবচে ভালো বন্ধু, সবচে ভালো গাইড বলতে সেই ছিল।
তার উৎসাহেই আমার আবারও ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত আসা,
(বলা ভালো, বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে তার পাশে পাশে থাকতে পারব এই আনন্দই আমাকে বেশী টেনেছে তখন)।

যশোরে ফিরে যাবার পর যোগাযোগের সেই প্রস্তুর যুগেও নিয়মিত চিঠি লিখে আমাকে নিরন্তর উৎসাহ দিয়েছে সে।
এমনকি এসএসসির আগে কিছুদিনের জন্য আমাদের বাসায় গিয়ে আমাকে পড়াশুনায় গাইড করেছে।

আমার চেয়ে বয়সে বড় এবং প্রবল ব্যক্তিত্বের প্রভাবে কখনওই বন্ধু বলতে সাহসী হইনি,
যদিও মনে মনে সেটাই ভাবতাম।
মনে পড়ে, পঁচানব্বুইয়ে যখন ইন্টারে পড়ার জন্য আবার ঢাকা এলাম,
সে তখন মাত্র বুয়েটে ভর্তি হয়েছে। আমি তখন পারতে সারাদিনই তার সাথে থাকি।
আমাকে নিয়ে একদিন সোহরাওয়ার্দী হলে এক সিনিয়রের রুমে গেল। সিনিয়র আমাকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, কে?
সে বলল, আমার বন্ধু!!! আমার পৃথিবীটাই যেন সেই মুহুর্তে রঙিন হয়ে গেল।

ইন্টারে পড়ার সময়ে আমি থাকি শাহবাগ আর সে ফজলুল হক হলের স্টাফ কোয়ার্টারে, তার বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক।
প্রতিদিন বিকেলে আমার নিয়মিত রুটিন ছিল আমার চিকনা রেসিং সাইকেলটা নিয়ে সোজা ফজলুল হক হলে চলে যাওয়া। বড় আনন্দময় সে সময়গুলো।
সে আমার অনুপ্রেরণা হয়ে ছিল আমি উড়নচন্ডী হয়ে যাবার আগ পর্যন্ত।

তারপর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে মুহসীন হলে উঠে এলাম,
তারাও ততদিনে ফুলার রোডের কোয়ার্টারে চলে এসেছেন।
এত কাছাকাছি; কিন্তু কোথায় যেন কি ভেঙ্গে গেছে, কিভাবে, কখন, কিছুই জানতে পারলাম না।

এখন তিনি আর্কিটেক্ট, নিজের ক্ষেত্রে ঈর্ষা জাগানো সব কাজ করে যাচ্ছেন একের পর এক। আমরা এখনও খুব কাছাকাছি থাকি।
মাঝে মধ্যে সামনে পড়ে গেলে গাড়িতে আমাকে লিফট দেন। কখনও সখনও নিজে ড্রাইভ করলে আমি তার পাশেই বসি।
মাঝে মধ্যেই বুকের মধ্যে ঢাক গুড় গুড় করে উঠলেও আগের মত আর সুর ওঠেনা বাঁশিতে।
এভাবেই হয়ত সব ভেঙ্গে পড়ে, আর পৃথিবী এগিয়ে যায় সামনে।

আজ তার জন্মদিনে শুভেচ্ছা।

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.