আনারকলির গল্প
আজ ১৮মে ২০১০
অনেকদিন পর পিসিটা ফিরে এলো।
গত সোমবারের আগের সোমবারে দেয়া, আর পেলাম আজ সোমবার।
বিদ্যুৎচমকের সঙ্গে সঙ্গে ঠাশ ঠাস করে কী যেন পুড়ে যায়। পরে পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখি, পাওয়ারবক্স পুড়ে গেছে। প্রথমে ভেবেছিলাম ইউপিএসটা গ্যাছে। আইডিবিতে নেয়ার পর দেখা গেলো শুধু পাওয়ারবক্স না এজিপি কার্ডও গ্যাছে। এজিপি কার্ড ছিল বিল্টইন সিস্টেম তাই পুরো মাদারবোর্ড রিটার্ন। রিটার্ন পেতেই এতো সময় লাগলো। কেন এতোদিন লাগলো সে প্রশ্ন করিনি, কারণ বিদ্যুৎচমকে পুড়ে গেলে তারজন্যতো তারা দায়ী নয়। তবে এর আগেওতো বিজলিচমক হয়েছে অন্য জিনিস পুড়েছে এবং এবারো ভাইয়ার পিসির পাওয়ারবক্স পুড়ে গেছে আরতো কিছু হয় নাই! আমারটার হলো কেন? আর এই জিনিসটাযে একটু দুর্বল হয়েছে সেটা তারাও বুঝতে পারছে.....জিনিসটা দিয়ে ঠিক করেনি এমন কথাও বলেছে মনজুর ভাই। যাইহোক অল্পতে বেঁচে গেলাম এটাই সান্ত্বনার, যদি ইউপিএস যেত, কিংবা ওয়ারেন্টি না থাকত?.....
পাখি অনেকদিন থেকেই বাড়ি যাওয়ার জন্য আইঢাই করছিল, বাবুকে ছেড়ে থাকতে কষ্ট হবে বলে সম্মতি দেইনি। এবার তবু গেলো। ভেবেছি বাবুর ভগ্নস্বাস্থ্যটা যদি এতে ফেরে! মানুষজন পাবে আনন্দফুর্তি করবে, খাবে দাবে....স্বাস্থ্য ভালো হবে। .....আর এইফাকেঁ আমি আমার পিএইচডির কাজটা আগাতে পারবো। পিসির কারণে সেটা হচ্ছিল না। অবশ্য কম্পিউটারে গবেষণামূলক কাজ করা এখন রিস্কি। যে কোনো মুহূর্তে লোডশেডিং, গেলে আর আসে না। তারচেয়ে কাগজ-কলমের সিস্টেমটাই ভালো। কিন্তু কম্পিউটারে লিখলে ইচ্ছেমতো লেখা যায় আর দ্বিতীয়বার লেখার ঝামেলা থাকে না। এখনই কি শুরু করবো নাকি? আবুসয়ীদ আয়ুবের ওপর একটা নিবন্ধ রচনা শুরু করবো?
ভাবতেই পেটের ভেতরটা লাফিয়ে উঠলো। কিছু খেতে হবে। গতকাল দুপুরে খেয়েছি তারপর আর তেমন কিছু খাওয়া হয়নি। আজ সকালে একজন হালকা নাস্তা করিয়েছে। একজন কি পরিচয়ই বলতে পারি, ইমরান; সিআরপি’র অর্থোসিস্ট ছিল এখন আছে জারা মোবিলিটির ডিরেক্টর হিসেবে। ইমরান বলেছে এবার সে যে প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে তা দিয়ে আমাকে দৌড় দেওয়াবে।....আমিও আশাবাদি। এমনিতেই সে অনেক মেধাব্যায় করে এ কাজে। আমি জানি তার সাফল্য সুনিশ্চিত ইনশাআল্লাহ! তবে আমার ক্ষেত্রে কতোটা সফল হবে জানি না। আমার পাটা কাটা হয়েছে এমন সাইজে এটা কোনো কাজই না। না ওপরে না নিচে, এখনতো আর নতুন করে কাটা যায় না! তারপরও একেরপর এক অর্থোসিস্ট চেষ্টা করে যাচ্ছে।.....
একটু আগে ঘরটা ঝাড় দিচ্ছিলাম, সে সময় আনারকলি ফোন দেয়- আনারকলির জন্য খুব কষ্ট হয়, একজন মানুষ তার জীবনটা একপ্রকার অর্থহীন করে দিয়েছে। আমাদের সংসারে যতো গোলযোগ তার বেশিরভাগই অর্থনৈতিক কারণে। কিন্তু সে সমস্যা আনারকলিদের নেই, ছিল না। তাদের সমস্যা একজন বিত্তবান মানুষের যে চারিত্রিক সমস্যা হয় তা-ই। আনারকলির কোনো অভাব আছে এমন কিছু চোখে পড়েনি আমার। সে ভালো আছে। মেয়েরা স্বামীহারা হলে সবেচয়ে বড় ভয় পায় যেটা নিয়ে সেটা হলো কী খাবে, কে খাওয়াবে, কীভাবে বেঁচে থাকবে..এসব নিয়ে। আনারকলির নিজের ফ্ল্যাট আছে ধানমণ্ডিতে, আটাত্তর লাখ টাকা দিয়ে কেনা। গাড়ি আছে ৬টা, ২টা ব্যবহার করা হয় আর বাকি চারটা শো রুমে। ব্যাংকের খবর জানি না তবে এইটুকু জানি জয়েন্টভেঞ্চারে গার্মেন্ট করতে চেয়েছে।....অতএব স্বামী বা উপার্জনের লোক তার প্রয়োজন নেই। তার বড় মেয়েটার সদ্য বিয়ে হয়েছে, পড়ছে আর্কিটেক্টে। ছোট মেয়েটা ক্লাস ফোরে। আপাতদৃষ্টিতে যে কারও মনে হবে সেতো সুখিই। কিন্তু সেই জানে সে কতোটা সুখি।....বড় মেয়ে জামাইসহ সে বাড়িতেই থাকে। বড় মেয়ের দেখাশোনা যা করার তা তার স্বামীই করতে পারছে। আর আনারকলির কাজ হলো ছোট মেয়েটাকে স্কুলে দেয়া নেয়া করা। কিন্তু বাকী সময়টা?..... একদিন ছোট মেয়েটাও বড় হবে তারও সংসার হবে সেও চলে যাবে অন্যের ঘরে। তারপর? আনারকলি একা। যে একাকিত্ব তার এখনও। সন্তান মানুষই কি একজন মানুষের একমাত্র ব্রত? সন্তান নিয়ে মেতে থাকাইকি একজন মানুষের একমাত্র সুখ? একমাত্র প্রাপ্তি? তার নিজের কি শরীর মন চাওয়া বলে আর কিছু নেই? হাদিসের পরিভাষ্য থেকেও জানা যায় তিনমাসের বেশি একটা মেয়ে একা থাকতে পারে না, অর্থাৎ স্বামী ছাড়া থাকতে পারে না। কিন্তু আনারকলি? সেতো অনেকবছর হলো নিজেকে ঠকিয়ে আসছে। কিন্তু এই মধ্য বয়সে আমাদের দেশের মেয়েদের বর জোটে না। সমাজ সেটাকে ভালোভাবে নেয় না। সন্তানরাও সেটাকে মানতে পারে না। তাহলে এখন আনারকলির করণীয় কি?.....
সে বন্ধু খুঁজছে। বন্ধু মিন স্বামীই। সে কি পাবে তেমন কোনো মানুষ? হয়ত পাবে কিন্তু আপাতদৃষ্টে সেটা এতোটাই অসম্ভব যে ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবে না। আর এই অসম্ভাব্যতা যখন একজন মানুষের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায় সে কীভাবে হাসে? হয়ত পরিবারের অন্য সদস্যদের অসুখি হবার ভয়ে সে প্রতিনিয়ত ভান করে যাচ্ছে আমি ভালো আছি....ভালো আছি.....
না, ক্ষিধেটা জ্বালাচ্ছে খুব। কিছু খেতেই হবে। কিন্তু কী ভাবে নামবো ৬তলা থেকে? সে শক্তিওতো নেই। আর রান্না করারও ইমেজ পাচ্ছি না। থাক ঘুমিয়ে নেই একটু।
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন