গল্প: সুখী মানুষ
উল্লেখ করার মত কিছু নয়।
এমন প্রফেশনাল বিহেব করছ কেন?
জীবনের কিছু জটিলতম অধ্যায় থাকে, যখন মানুষ না পারে কোনও প্রতিক্রিয়া করতে, আর না পারে প্রতিকার করতে।
একটু খুলে বলবে?
আমার জীবনটা কেন এমন হলো বলতে পারো? অল্প বয়সে বিয়ে করেছি এটাই কি অপরাধ?
অল্প বয়সে কোথায়, যথাসময়ে করেছ। এ বয়সে মানুষ বিয়ে করে না?
তাহলে কি বলবে তোমার বিয়েটা অনেক বিলম্বিত হয়ে গেলো।
নিশ্চই!তবে আমি ভালো আছি, অন্তত এখন ভালো আছি। এই চাকরিটা পাবার পর জীবনটাকে ভিন্নস্বাদে পাচ্ছি।
একটা অবলম্বন! আমাদের সমাজ বিয়ে ছাড়া জীবনটাকে ভালোভাবে দেখে না, তা না হলে আমি কুমারী থাকতে সাজেস্ট করতাম।
সাজেস্ট না করলেও তাই থাকবো। ফ্যামিলিতে সেরকম তাড়া আার এখন নেই। ছোটবোনটার বিয়ে ঠেকে ছিল, তারও এনগেজ হয়ে গেছে। প্রথমে প্রেম, তারপর সেটেলমেন্ট। ওর জন্য বাড়িতে বেশ আয়োজন চলছে। ওর সংসারের জন্য ফার্ণিচার বানানো, গহনা বানানো, মার্কেটিং করাÑ কত কীই না হচ্ছে..
তোমার খারাপ লাগে?
হয়ত লাগে। ওই যে বললে প্রতিক্রিয়াও করতে পারি না, প্রতিকারও করা যায় না।
তুমিও বিয়ে করে ফেলো! ঐ যে ফাগুন না কে ছিল, তোমার ভক্ত! সে কি আছে?
তুমি কি ভাবছ পাত্র সঙ্কটে বিয়ে করতে পারছি না?
সৎপাত্রের সঙ্কটে..
কোনওটাই না। আমার আসলে বিয়েতে কোনও আগ্রহ হচ্ছে না। বীতকামশ্রদ্ধা।
একটা বয়সে এসে এমন হয়। সবকিছুরই একটা বয়স আছে। সময় আছে। সেই সময়ে না হলে আগে-পিছে হলে কিছু জটিলতার সৃষ্টি হয়।
তারমানে তুমি বলতে চাইছ আমার বিয়ের বয়স চলে গেছে?
উর্বর বয়সটা বোধয় গেছে। নাকি যায়নি?
যায় যাক। আমি গবেষণায় মনোসংযোগ করতে চাই। বিয়ে করে সংসারী হওয়ার এই ধারাবাহিকতার জন্য মানুষ জীবনে অনেক জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
প্লেটো বোধয় সেজন্যই আইডিয়েল রাষ্ট্র’র থিম দাঁড় করিয়েছিল এভাবে...!
আবার সেটা পাল্টেও গেছে। ব্যর্থ হয়েছে প্রয়োজনের কাছে। ভ্যালেন্টিন এর কাছে। তবে সে ব্যর্থ হয়েছে. সে তার চিন্তাকে সবার মাঝে প্রতিফলিত করতে চেয়েছেন। এককভাবে কেউ কিছু চাইলে, চিন্তা করলে; এককভাবে সে সফল হতেও পারে। আমিতো আর সবাইকে বোঝাতে পারব না যে বিয়ে না করা ভালো, বিয়ে না করে পিএইচডি করা ভালো... বরং আমি নিজে কাজটায় সফল হতে চাচ্ছি।
তুমি যদি আমাকে এই আশ্বাসটুকু দিতে.. আমিও হয়ত বিয়ে নামক ফাঁদে পা দিয়ে জীবনটাকে এমন অর্থহীন করে তুলতাম না।
কী রকম আশ্বাস?
তুমি সেদিন সরাসরি আমাকে অস্বীকার করলে কেন? তোমার সঙ্গে জিদ করেই তো হুটকরে সিদ্ধান্ত রিলাম। সে আমি জানি। আমার সেদিনের ভুলটি আমি যখন ভাবি তখন খুব জেদ হয় নিজের উপর। কত সুন্দর হতে পারতো জীবনটা। সংসারেও আমাকে এমন মূল্যহীন হয়ে থাকতে হতো না। সবাই কেমন গলার কাঁটা ভাবে...
এখনও ভাবে?
এখন ভাবে না, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছিতো । আর সেজন্যই চাইছি বাড়ির সাথে কোনও যোগাযোগ রাখব না। তাদের ইচ্ছাটাও পূরণ হতে দিব না।
আমি বিয়ে করে অসুখী আর তুমি বিয়ে না করে অসুখী! ব্যাপারটা যেন কেমন
“দিল্লিকা লাড্ডু! খাইলেও পস্তাইবেন, না খাইলেও পস্তাইবেন” সেরকম। আচ্ছা তোমার বউর কথা বলো, কী করে সে?
সে যা করে তা আর কাউকে বলা যায় না।
কেন, ভালইতো শুনেছিলাম
প্রথম প্রথম অমন ভালই শোনা যায়। বিয়ে করেই কেই সমালোচনায় নামে? এটাকি হাসিনা খালেদার রাজনীতির মাঠ নাকি যে ক্ষমতাগ্রহণের প্রথমদিন থেকে সূক্ষ কারচুপি,স্থূল কারচুপি ইত্যাদি ইস্যু তুলে শুরু করলাম গণতন্ত্র চর্চা- হরতাল-অবরোধ-ভাঙচুর আর বিরোধিতা!
ও আচ্ছা ভালো কথা! তুমিতো রাজনীতি করতে, ক্যাম্পাসে থাকতে। এখন কী অবস্থা?
রাজনীতি ছিল আমার বর্ম। আমার বেঁেচে থাকার শেল্টার। হলে সিট পাওয়া ডাইনিংএ সুবিধা পাওয়া, এক ওকে ভয় দেখানো, সবার সালাম-সমীহ পাওয়া এসবের মজাই আলাদা।
তুমিও ডাইনিংএ বাকী খেতে নাকি?
না, সেটা করিনি, তবে রুমে যেদিন খাবার পাঠাতে বলতাম ওরা এক বিলে তিন চার জনের খাবার পাঠাতো, এই আরকি? আমি নিষেধ করতাম, ওরা এতেই খুশি। অন্যদের মতো চাপ দিচ্ছি না, চাঁদা নিচ্ছি না এটা ওদের কাছে অনেক বড় পাওনা।
একবার না মারপিট করছিলা?
কী নিয়ে/ কার সাথে?
আরে ওই যে কে না একটা ডাইনিং বয়কে চড় মারল.. ..
ও! জহুরুল? শান্ত-নিরীহ মজার একটা পিচ্চি। সবার সঙ্গে বাবরমার্কা ইংরিজি বলতো। সবাই ওকে আদরও করতো। আর আদরের দাবিতে মাঝে মাঝে এমন কথাও বলত যে কেউ বেয়াদবিও ধরত। অরিত্রের মতো ইচরে পাকা আরকি! তো ছাত্রলীগের এক ছেলে ওকে বলেছে এক্ট্রা দিতে ও বলে টোকেন দিতে, এই নিয়ে ক্যাঁচাল, ঠাশ করে দিল এক থাপ্পর। একটু পর আমি খেতে গিয়ে দেখি ও কাঁদতেছে আর বাটিপ্লেট সার্ভ করছে। জিজ্ঞেস করলামÑ কী ব্যাপার? ওতো অভিমানে বলবেই না, পাশ থেকে এক ছাত্র বলল, মারছে, কে মারছে? অমুক। ব্যাস! একজনরে দিয়ে ডাকিয়ে এনে জিজ্ঞেস করলাম, সে কি ত্যাড়া উত্তর ছেলেটার। আমি বললাম একঘণ্টার মধ্যে যদি তুমি এর সমাধান না করো, শিশু নির্যাতনের অপরাধে আমি তোমার ছাত্রত্ব বাতিল করাবো। ওর কাছে মাফ চাও, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দেও। সেই ছেলেতো ত্যাড়া কম না! উল্টো বলে আমার ইচ্ছা আমি মারছি। আমি সঙ্গে সঙেগ প্রক্টরকে ফোন দিলাম, স্যার আপনারকোনও ছাত্র যদি শিশু নির্যাতন করে আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোড অফ কন্ডাক্ট অনুযায়ী তার সাজা কী?
এই কথা বলার পর ছেলেটা ছোট্টকরে বলে যে সস্তা প্রেম দেখানোর আর যায়গা পায় না! সঙ্গে সঙেগ ডেকে দুইগালে থাপ্পর মারতে মারতে ডাইনিং এর বাইরে পাঠিয়ে দিলাম। দুই দিক থেকে দুইটা গ্র“প খেপে গেলো। একটা ওর একটা আমার পক্ষে। স্বাভাবিকভাবেই আমার পক্ষে সংখ্যা বেশি। থমথমে অবস্থার মধ্যে আমি বললাম আজ রাতের মধ্যে তুই হল ছাড়বি। ওরাও চ্যালেঞ্জ নিল। রাতে সবাই রেডি। সে রাতেই কিন্তু আমার মোবাইল হারায়। আমি তখন প্রক্টরের বাসায়, স্যার আরও কজন স্যারসহ বসেছেন মীমাংসা করতে। এর মধ্যে শুনি ওই ছেলের বেড পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। বইপত্র সব নিচে ফেলে দিয়েছে।..
গ্যান্জামটা অনেকদূর গড়িয়েছিল! তোমাকে ভয় পেতাম তখন থেকে। তবে এটা সত্য, তোমাকে কেউ মাস্তান বলত না। আর সবার মুখে তোমার এতো আলোচনা শুনতাম! ভাবতাম ইশ! একদিন যদি একটু কথা বলার সুযোগ হতো!
একটা দুসংবাদ জানো?
কী?
কয়েকদিন আগে শুনলাম জহুরুল আত্মহত্যা করেছে।
মানে? হুঁ, ওতো এখন অনেক বড় হয়েছে।
আয়তন নিশ্চই বাড়েিেন! হয়ত না, ওতো বেঁটে ছিল।
আত্মহত্যা করল কেন?
তোমরা আমরা যে কারণে করি!
মানে ? ঘরের যন্ত্রণায়?
না, মনের যন্ত্রণায়। আমরা ওকে সোনিয়ার কথা বলে খ্যাপাতাম! সোনিয়া ছিল ডাইনিং ম্যানেজার হাসানের মেয়ে। পড়াশুনা করতো। আর সুযোগ পেলেই দুইটায় মিলে হলের পেয়রাগাছগুলো উজাড় করত। আমলকির গাছ, আম, সবই ওদের দখলে থাকত। সেই সোনিয়ার সাথেই নাকি ওর মন দেয়া নেয় হয়, কিন্তু হাসান সোনিয়ার বিয়ে দেয় ভ্যানঅলা মিজানের সাথে। মিজানও আগে ডাইনিং এ কাজ করত, পরে আরকি ভ্যান কিনে চালানো শুরু করে।
এতোকিছু ঘটে গেছে এর মধ্যে! শিট! জহুরুলের জন্য খুব খারাপ লাগছে। ছেলেটা খুব কালো হলেও চেহারায় মায়া ছিল। কিন্তু হাসান ভাই এই ভুলটা কেন করল? সোনিয়াকে আমরা দেখে এসছি ক্লাস ফোরে, সেই মেয়ে এখন না হয় ক্লাস নাইনে উঠেছে! এরই মধ্যে বিয়ে?
ওদের জন্য সবই সম্ভভব! ওরা মনে করে ওরা গরিব, তাই।
যাইহোক, চলো যাবে একবার, সেই পুরনো ক্যাম্পাসে? আমার কিন্তু মনে আর কোনও কষ্টই নেই। মনে হচ্ছে আমি আমার সেই আগের জীবন খুঁজে পেয়েছি।
ইচ্ছেতো করে, কিন্তু..আচ্ছা লায়েক নাকি জয়েন করেছে?
হ্যাঁ, প্রায় বছর হতে চলল!
তোমার খবর কি?
এখনও স্বপ্নের মধ্যে বসবাস!
বাদ দেও। পারিবারিক কলহ-অশান্তিকে মন থেকে একদম মুছে ফেলে জীবনটাকে সাজাবার চেষ্টা করো। তোমারতো অনেক সুযোগ আছে। তোমার রেজাল্ট ভালো, রিলেশন ভালো, সোর্স আছে।
আমার আর কোনও দুঃখ হয় না, দুঃখ একটাই, যদি ও অনার্সটা করতে পারতো। একটা অনার্স পাশ মেয়ে যদি আমার বউ হতো! ও সুন্দর অসুন্দর গরিব ধনী আমি বিচার করতাম না। বিশ্বাস করো!
সে আমি জানি, তোমাকে পেয়ে যেই মেয়ে সুখী হতে পারেনি বা সুখী করতে পারেনি সে যে কত হতভাগা! আমি আমার এই জীবনে তোমার একটাই দুর্নাম শুনেছি, তুমি প্রচণ্ড রাগী, আর না হয় তোমার এমন কোনও দিক নেই যার জন্য তুমি অসুখী হবে। তোমার বউকে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দাও! ওখানেতো আর টেকা না টেকার ব্যাপারটা বড় না!
আমি চাইলেতো হবে না, তারও চাইতে হবে
সে চায় না?
সে চায়, সে চায় বিবিএ করার টাকাটা দিয়ে ব্যবসা করবে, বড়লোক হবে। ওর আফসোস আমি কেন এত মেধাবী হয়েও ওর স্বল্পশিক্ষিত ভাই সাঈদের মতো কোটি কোটি টাকার মালিক হতে পারলাম না!
টাকা দিয়ে করবে কি সে?
সেটা আর শুনবে কি? গতকাল নেটে বসে ক্রেডিট কার্ড চেক করে দেখি মিনা বাজার থেকে কিনেছে দুইহাজার টাকার জিনিষ, ক্যাসিস থেকে ৯০০টাকার কার্ড পাঞ্জ করেছে। প্রায় প্রতিদিনই তার মার্কেটে যাওয়া লাগে।
কোন রাজকণ্যাকে ধরে এনেছ তুমি?
রাজকণ্যা? বিয়ের আগে যদি দেখতে ওর পোশাকের ছিরি? একটা পাউডার পর্যন্ত পায়নি বাপের সংসারে।
এমন মেয়ের সাথে জড়ালে কীভাবে?
ওর ভাই পড়ত আমাদের ভার্সিটিতে। ওও টিচার এখন। ছেলেটা খুব মেধাবী এবং খুবই ভালো। আমিতো সবকিছু বিবেচনা করেছি ওকে দেখে। এবং ওকে কষ্ট দিতে হবে ভেবেই ওর বোনকে আর না করতে পারিনি। এখন ও দেখে ওর এক ভাই ভার্সিটির টিচার, আরেকভাই বিদেশে বসে কোটি কোটি টাকার সম্পদ বানিয়েছে আর আমি? না আছি টাকায় না আছি সেরকম সম্মানে। কথায় কথায় খোঁচা মারে।
ইশরে! যন্ত্রণাটাতো ভালোই। চলো একবার ক্যাম্পাসে বেড়াতে যাই। ওকেও নিয়ে এসো। দেখি কাউন্সেলিং করে কিছু করা যায় কি না।
যদি ততদিন সংসার আমাদের টেকে!
না, না এ কাজ করো না। আর যাই হোক অমুক টিচারের বোন এই পরিচয়টুকুতো দিতে পারো, এর চে শোচনীয় অবস্থাও আছে কারও কারও। রাশেদের খবর জানো?.. .. ..
কেন কী হয়েছে রাশেদের?
আরে ও যে কোচিং এ পড়াতে গিয়ে এক ছাত্রীর সঙ্গে প্রেম করল, জানো না?
জানিতো!?মেয়েটা ওকে পাত্তা দিত না, তারপর রাশেদের মাস্টার্সের রেজাল্ট শুনে পাত্তা দিল; তারপর কি?
আরে তারপরইতো কাহিনী। মেয়েটার আগের প্রেম ছিল, মামাত ভাইর সাথে..সেসব নিয়ে অনেক কেলেঙ্কারি! আরেকদিন শুনো। আজ অনেক হলো রাখি!..
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন