যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ!
-মামুন মাহফুজ
আশরাফ ভাই আমার পুরনো এক বন্ধু; পুরনো মানে বেশ পুরনো। পরিচয় ১৯৯৫ সালে, অর্থাৎ আজ থেকে ১৫ বছর আগে। সে তখন এসএসসি দেবে, আর আমি তার পরের বছর দিলাম। সম্পর্ক ধীরে ধীরে সুসম্পর্কে দাঁড়ায়, মুরুব্বিরা এমন কথা বললেও আমাদের সম্পর্ক সু-তে পরিণত হতে বেশি সময় লাগল না। কারণ সময়টা তখন সু ছিলনা। দু:সময়ে দ্রুত বন্ধৃত্ব তৈরি হয়, এটাই নিয়ম; খালেদা বিরোধী আন্দোলনে দেশে তখন তোলপাড় অবস্থা বিরাজ করছে।
১৯৯৯ সালটা যেমন সহস্রাব্দের পূর্ব মহূর্ত ঠিক তেমনি আমাদের জীবনে বাঁক নেওয়া, ভাঙাগড়ারও মুহূর্ত। এইচএসসি পাশ করে কোথাও ভর্তি হতে না পেরে নিজের মাতৃভুমি এক অজপাড়াগাঁয়ে পালিয়ে গেলাম। এই পরাজিত মুখ আমি কাউকে দেখাবো না। কিন্তু বছর না গোহাইতে আবার ভর্তি পরীক্ষার সময় চলে এলো, এবার শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিলাম। অবশ্য বলাইবাহুল্য ঢা.বিতে পরীক্ষা দেওয়ার মনোবলই আর ছিল না। হার্টএন্ড সোল ট্রাই করে ই.বিতে চান্স হলো। সেই সুবাদে ঢাকায় এলাম নিজের ব্যাগবোচকা নিতে। এসময় আবার আশরাফ ভাইর সঙ্গের সম্পর্কটাকে আরও মজবুতভাবে উপলব্ধি করলাম। বিশেষ করে এসবিতে চড়ে আমি যখন বিদায় নিচ্ছি কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে আশরাফ ভাইর মতো লাজুক ছেলেটাও কেমন যেন ভাঙা-জড়ানো কণ্ঠে বলে আরেকটা দিন থেকে গেলে কী হতো? ঠিক সে সময় প্রচণ্ড খারাপ লাগছিল, কিন্তু কাঁদতে পারিনি, আমার মনে হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়ে আমি অনেক বড় হয়ে গেছি, সেই পোলাপান আর নেই। এর ঠিক পনেরদিন পর আবার ঢাকায় ফিরলাম এম্বুলেন্সে চড়ে। এভাবে একেরপর এক ঘটনা-দুর্ঘটনা আমাদের একত্র করে রেখেছে। ঘটনার পরম্পরায় আমরা না চাইলেও টিকে থেকেছে সম্পর্কটা। ২০০৭ সালের শুরুতে চাকরির সুবাদে আবার ঢাকায় ফেরা। আশরাফ ভাই তখনও লেগে আছে তার ডিজাইনের চাকিরটাতে। বেতন-কড়ি খারাপ না, খ্যাতিও আছে কিন্তু ওর অভিযোগ এটা কোনও ক্যারিয়ার না। ধীরে ধীরে ওর এই অনুভূতি তীব্রতর হলো এবং এক পর্যায়ে ধুম করে চাকরিটা ছেড়ে দিল। শুরু করলো বিসিএস কেন্দ্রিক পড়াশুনা। একদিকে বেকার লাইফ তার অন্যদিকে বেটার লাইফের জন্য লাইব্রেরিতে বসে প্রাণান্তকর চেষ্টা। অবশ্য আমরা মাঝে মাঝে খোঁচা দেই বেটার হাফের কথা বলে। ঠিক এই ট্রানজিশন পর্বে তার একদিন মনে পড়লো কোনও এক কালে তাদের বন্ধুদের (ঢা.বি’র) একটা সমিতি ছিল। ইচ্ছাপোষণ করলেন সমিতিটা চাঙ্গা করার। মুখে বললেন বেকার মানুষ যদি তোমাদের সমিতিটা করে কিছু টাকা পয়সা পাই নিজের হাতখরচটাতো চলবে। আমরা কেউ আপত্তি করিনি। বলেছি যতোকাল সে বেকার থাকবে এখান থেকেই চালিয়ে যাক আকার ফিরে এলে আমাদের ফিগারটাও ফেরৎ দিতে হবে। সমিতির টাকাটা ব্যাংকে রেখে এবং শেয়ার বিজনেসে পরীক্ষামূলক কাজে লাগিয়ে বেশ ভালো একটা বেনিফিটও সে জয় করলো। এদিকে তার বিসিএসের রেজাল্টটা আইনী জটিলতায় আটকে থাকলেও এক্সিমব্যাংকের চাকরিটা হয়ে গেলো। আমরাতো ভয়াবহরকম খুশি! যেই ক্যারিয়ারের জন্য এতো বড় ত্যাগ! ২০-২৫হাজার টাকার চাকরি ছেড়ে নতুন করে পড়াশুনা শুরু করা সেই ক্যারিয়ারটা অবশেষে শুরু হলো! এবার আর পাত্রীপক্ষকে ডিজাইনার পদটি বোঝানোর জন্য কাঁইকুঁই করতে হবে না। একবাক্যে বললেই হবে ছেলে ব্যাংকার। তা ছাড়া ব্যাংকের ড্রেসকোড মেনে দুয়েকমাস অফিসে যাতায়াত করলে এমনিতে সবাই ধরে নেবে দামী পাত্র হিসেবে। অতএব শুভস্যশীঘ্রম ঘটতে যাচ্ছে। বিশাল আকারের মজা করার জন্য আমার অফিসকে অগ্রিম হুমকি দিয়ে রেখেছি, চাহিবামাত্র ছুটি দিতে বাধ্য থাকিবে। এদিকে আশরাফ ভাইর অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গেছে। সে আমাকে ডিফল্ডার বলার চেষ্টা চালাচ্ছে। গতমাসে ঈদপার্বণ থাকায় মাসের কিস্তিটা দিতে পারিনি এবং এ মাসেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিলটা পেতে দেরি হওয়ায় এখনও কিস্তি দিতে পারিনি, এতেই আমি ডিফল্ডার! শালা ব্যাংকার! বেচারাতো মনে হয় ব্যংকের বাংকারে ভালোই সেধিয়ে গেছে! ফোন করে কিস্তির টাকা চায়! গ্রাহককে তাগাদা দেয়! একেই বলে যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ! ব্যাংকাররা কখনও কারও কাছে টাকা ফেলে রাখে না। যা পায় বিনিয়োগ বাড়ায়। আমার এক মামা আছে সে বেতন পায় ৩৫-৩৬ হাজার টাকা, কিন্তু একহাজার টাকা ঋণ চাইলেই কেমন কাঁইকুঁই শুরু করে। জয়তু ব্যাংকার মহোদয়! আপনারাই পারবেন জাতিকে অলসতা থেকে মুক্ত করতে।
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন