কৃষিবিপ্লবের নাটক
দেশ টিভি যখন অনএয়ারে আসে তখন থেকেই আমরা অনেক স্বপ্নবাদী ছিলাম, যে কিছু একটা করে দেখাবে। কিন্তু সে তুলনায় তেমন কিছুই আমরা পাইনি এই চ্যানেলটির কাছে। তাই অল্পদিনেই আমরা বাঙালিরা মুখফিরিয়ে নিয়েছি কিন্তু সত্যিই কি কিছু দিতে পারেনি? এই বিবেচনা নতুন করে ভাবিত করছে গতরাতের একটি নাটক দেখে একজন অসংলগ্ন অথবা স্বাভাবিক মানুষের গল্প। দেশ টিভিকে প্রথম ভালো লেগেছিল নতুন মাত্রার নাটক দেখে এখন মনে হচ্ছে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ভালো করিনি; বাঙালি বলেই হয়ত আমরা সহসা হতাশ হই মুখ ফিরিয়ে নেই আমার হুজুগে ভাসি। নাটকের ক্ষেত্রে দেশ টিভি এখনও কি ভিন্নমাত্রার নয়?
এবার আসুন নাটকটির ব্যাপারে।
একটি ম্যাসেজ পুরনো হলেও আজ দেশের জন্য চরম মূল্যবান। বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ, এদেশে কৃষি বিপ্লব চাই। খুবই যুগোপযোগী একটি ম্যাসেজ। আরও একটি ম্যাসেজ হলো আমাদের সংস্কৃতি বনাম বৃটিশভুতের দাসত্বপ্রথা-সংস্কৃতির যুদ্ধ। বেশ সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছেন।
নাটকের মান আর্ট কিংবা সাফল্য নিয়ে আমি প্রশ্ন আমি তুলব না, সে অধিকার আমার নেইও। প্রথমেই ভিমড়ি খেয়েছিলাম এত্তো বড় নাম দেখে। গল্পের কবিতার নাটকের বড় নাম দোষণীয় না হলেও নামের যেটুকু শিল্পত্ব তা ছোট'র মধ্যেই নিহিত। হয়থ নামটি হতে পারতো 'ফেরা' কারণ নায়ক তার মানুষ তার আপন সংস্কৃতিতে ফিরে গেছে।....
তার আগে কিছু প্রেক্ষাপট বলি...
সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচার দিতে গিয়ে অনেকটা আবেগাপ্লুত হয়ে বলেছিলাম বাংলাদেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার লড়াইয়ে নামতে হবে, আর তার জন্য শত শত উচ্চ-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তৈরি না করে কৃষিবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন। সরকার যে প্রতিটি জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় করার ঘোষণা দিয়েছে এটি কি দেশের জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে? দেশের সব মানুষকে উচ্চশিক্ষিত করলে বিভিন্ন সেক্টরে কারা কাজ করবে? এমনটি যদি হয় একজন নরসুন্দরও এমএ পাশ সেটি কি কারও জন্য সুখকর হবে? বরং পরিকল্পনানুযায়ী সব সেক্টরের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা দিয়ে প্রয়োজনীয় জনবল তৈরি করলে যেমন হোঁচট খেতে হবে না তেমনি বেকারত্বের অভিশাপও সইতে হবে না। জানি না ছাত্রছাত্রীরা কতোটা বুঝতে পেরেছে....
অনুরূপভাবে অফিস থেকে ফেরার পথে গাড়িতে এক কলিগের প্রশ্ন থেকে শুরু হলো নতুন বিতর্ক। প্রথম আলোর রিপোর্টটা দেখেছেন?
না
তাইলে আর কী দেখছেন!
পত্রিকা পড়ি সকালে উঠে নেটে বসে। অথবা রাতে ঘুমাতে যাবার আগে। মেয়াদ শেষ নতুন রিফিল না করায় নেটে ঢুকতে পারছি না। তাই পত্রিকাও আর ওভাবে আর পড়া হয়নি।..
কী ছিল তাতে?
এরপরই উঠে এলো বিমানবন্দরের প্রসঙ্গ।
বলিসকি এমন রিপোর্ট করেছে প্রথম আলো? বিমানবন্দরের পক্ষে যে সবচেয়ে বেশি গলাবাজি করছে মতিউর সাহেবের ঘনিষ্ট বন্ধু সে। তারপরও?
আরেকজন বলে উঠলো তাইলে মনে করো ভেস্তে গেছে....
গাড়িতে একজনও পক্ষে নেই বিমান বন্দরের যখন জানলো শাহজালাল বিমানবন্দরটি চল্লিশভাগের বেশি ব্যবহার হয় না তখন নতুন বিমানবন্দর করে ৩০হাজার বিঘা কৃষিজমি কেন নষ্ট করা? কেন এতো মানুষের ভিটেবাড়ি দখলকরা!
কিন্তু দোহারবাসী একজন পক্ষে সবার সঙ্গেই গায়ের জোরে তর্ক করলেন। দেশকে উন্নত করতে এয়ারপোর্ট লাগবে। জিজ্ঞেস করলাম দেশের আরও যে কয়টা বিমানবন্দর আছে সেগুলো কেন এখন বন্ধ? দেশ কি সিঙ্গাপুর হয়ে গেছে? বরিশাল এয়ারপোর্ট করায় কী লাভ হয়েছে? নিজের চোখে দেখেছি রানওয়ে কীভাবে কৃষিজমি দখল করে নির্লজ্জভাবে শুয়ে আছে।
সরকার একদিকে বলছে একইঞ্চি যায়গা ফাঁকা রাখবে না, চাষ করে ভরে ফেলবে, যে বা যারা জমি ফেলে রাখবে তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেবে সেখানে নিজেই কেন প্রাগমেটিক্স বিবেচনা ছাড়া বিমানবন্দর বানাতে চায়? বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ বিশ্বখাদ্যমন্দা যেভাবে দেয়ে আসছে তাতে বাংলাদেশের মতো হতদরিদ্র দেশে যে কোনওভাবেই কৃষিজমি সেভ করার চিন্তা করতে হবে। আমরা তিনভাইর জন্য তিনটি বাড়ির পরিবর্তে তিনতলা বাড়ি করছি, বাকী জমিটা রেখেছি পুকুর আর গাছগাছালির জন্য। আমার মা তাতে কদুগাছ, শিম, বরবটি শাক কচু , নারকেল সুপারিসহ দুয়েকটি বাদে মোটামুটি সব ফলের গাছ লাগিয়েছে। আমরা এতো করে তাকে ঢাকাতে আসতে বলি তিনি আসেন না। তার দম বন্ধ হয়ে যায়। ছোটভাইটা অসুস্থ তাকে দেখতেও আসতে পারছেন না বাড়ির মায়ায়, কাকে রেখে আসবে পাহারায়...আমরা বলি সন্তানের চেয়ে বড় হয়ে গেলো? আসলে এটিই মাটির টান। যারা উল্লসিত বাড়ির পাশে বিমানবন্দর হবে বলে আসলে তাদের বাড়িই থাকবে না। তাদের হতে হবে উদ্বাস্ত, থাকবে না পারিবারিক ঐতিহ্য। অভিবাসীদের মতো আনকোরা হতে হবে। অতএব জীবন দিলেও জমি ছাড়তে মানুষ রাজি হবে না।
কিন্তু সেই একজন মানুষ কোনওভাবেই মানতে রাজি নয়, তার বাড়ি দোহার, হয়ত এক ইঞ্চি যায়গাও তার নষ্ট হবে না বরং তার বাড়ির পাশেই হবে। সে তো পক্ষে থাকবেই। তবে সে জোরালো গলায় দাবি করলো আমার বাড়ি সেখানে আমি জানি সবাই বিমানবন্দর চায়, একজন বলে এটা অ্যামেরিকা না বাংলাদেশ, কোথায় কি হচ্ছে সবাই জানে আপনি একলা জানবেন কেন?
তর্ক কোনওভাবে শেষ হয় না। গলাবাজি করে আমরা সবাই ক্লান্ত
কেউ বলে নদী মাতৃক দেশে ব্রিজ কল্যাণ বয়ে আনে, যানজটের শহরে ফ্লাইওভার কাজে লাগে কিন্তু বিমানবন্দর কী কাজে লাগে?
তর্কের শেষ সেদিন হয়নি হলো পরদিন। আমরা দেখলাম কীভাবে রুখে দাঁড়িয়েছে আরিয়লবাসী। সরকারের ভুল সিদ্ধান্তে জীবন দিতে হলো একজন পুলিশসহ অজ্ঞাত অনেককেই হয়ত।ঘরছাড়া হলো গ্রামবাসী........।
আবার জনতার এ আন্দোলনকে জোরকরেই বিরোধীদলের ক্রেডিটে দিলেন খালেদা জিয়াকে বানালেন জননেত্রী, তার একটি ভাষণেই মানুষ এমন পাগলপাড়া হয়ে যায়! তাহলেতো ভাবতেই হয় তার শক্তিমত্তা! মামলা হলো তাঁরও নামে।...........।
এখন আবার বলছে বিমানবন্দর হবে পদ্মার ওপারে, কোনও চরে। হয়থ তাতে খুব একটা আপত্তি করবে না। কারণ চরতো কিন্তু সরকারকে ভাবতে হবে নিজের ইগো ত্যাগ করে সত্যিকারের দেশপ্রেমিকের মতো..........আর কোনও জমি এভাব নষ্ট করা ঠিক হবে কি না। সরকার যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা ইস্তেহারে বলেছেন তা না করে কেন খাদ্য উৎপাদনের জমি নষ্ট করছেন?
এসব বিবেচনায় দেশ টিভির এ নাটক আরও শক্তি জোগালো।
আমাদের এখনই শুরু করতে হবে কৃষি বিপ্লব! আমার বিশ্বাস শিক্ষতরা কৃষিতে ফিরে গেলে বিপ্লব হবেই। তারাই পারে কৃষককে জাগিয়ে তুলতে আর কৃষকরাই পারে মাটিকে জাগিয়ে তুলতে।......।
ইতোমধ্যে কিছুটা শুরুও হয়েছে। আমার এক বন্ধু জানলো সে ৩০ বিঘা জমি লিজ নিয়ে লালমনিরহাটে চাষ শুরু করেছে। বছরে তার একলাখ টাকা ইনভেস্টে ৩ লাখ টাকা আয়। লস হলেও লাভ কারণ কৃষক বাঁচলো, খাদ্যসম্পদ বাড়লো। প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে লস হবার সম্ভাবনা নাই। তবে সে যেটা বললো তাতে অনেক আধুনিকায়ন ঘটেছে চাষে। কারণ সে শিক্ষিত। সব শিক্ষিত মানুষকে কেন চাকরিই করতে হবে?
দেশটিভির নাটকটি নায়ককে স্বাধীন পেশায় কৃষিকাজে জড়িয়ে পড়তে দেখিয়ে সেই বিপ্লবী চেতনারই বহি:প্রকাশ করল। ধন্যবাদ দেশ টিভি। ধন্যবাদ প্রথম আলো। আসুন শেয়ারবাজারে কোটিপতিদের লড়াইয়ে নেমে কিছু লাভের আড়ালে সর্বস্বান্ত না হয়ে কিছু বিনিয়োগ কৃষিতে করি। কৃষককে একটি কৃষিযন্ত্র, সেচপাম্প কিনে দিয়ে হলেও চেষ্টা করি কৃষক বাঁচাতে তাহলেই বাঁচবে কৃষিপ্রধান দেশ বাংলাদেশ। যেখানে অযত্ন অবহেলায় এখনও বেড়ে ওঠে হাজারও গাছগাছালি। ভরে যায় ফুলে ফলে।...........।
আসুন ফেব্রুয়ারি মাসে আবার ফিরে যাই নিজ সংস্কৃতির কাছে। যতোটা পারা যায়।
একটি ত্রুটির কথা বলি---নাটকে সাইকিয়াট্রিস্টকে দেখে হ্যালো, নাইসটু মিট ইউ বলে নায়ক। এখানে সালাম দিলে বোধয় আরও বেশি মানানসই হতো। নতুন কাউকে আমরা সালামের মাধ্যমেই গ্রহণ করি। এমনকি আমার এক জুনিয়রকে দেখেছি হিন্দু ধর্মালম্বীসত্ত্বেও বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে মিশে যাওয়া সালাম কে ব্যবহার করে। বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে বাঙালিয়ানা এবং মুসলমানিত্ব মিলেমিশে একাকার! এতে দোষের কিছু দেখি না।.........।
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন