প্রাণপাখি
সূর্যের বুকে আছে যতটা আলো
তারও বেশি তোমাকে বেসেছি ভালো
ভালোবাসি বড় ভালো বাসি এর বেশি ভালো বাসা যায় না
ও আমার প্রাণপাখি ময়না।
গানটা তুহিনের খুব প্রিয়। ও পড়ছে ফরিদপুর পলিটেকনিকে। ওর বয়স্য ছেলেদের এ গানতো ভালো লাগবেই। কিন্তু গানটা আজ আমারও খুব ভালো লাগছে। প্রেম বোধয় সত্যিই কোনও বয়সের পরোয়া করে না। বয়সভেদে যে রুচির পার্থক্য ঘটে তাও কি আপেক্ষিক? তুহিনকে আমি ইন্টারমিডিয়েট সেন্টিমেন্ট’র মনে করি; এই গানটা সংগ্রহ করতে ও যে পরিমাণ কষ্ট করেছে অতোটা কষ্ট যদি অধ্যাবসায়ে ব্যয় করত নিশ্চই বাবা-মার মুখে হাসি ফোটাতে পারতো। ওর মতো ইমোশন আমার কাজ করে না। তারপরও আজ গানটাকে এতো রিপিট কেন করছি? কারণটা কি পাখির বিচ্ছেদ!
একেকটা মানুষ একেকরকম। বয়সভেদে – রুচিভেদে মানুষের নানা রূপ দেখা যায়। আছে স্ট্যাটাস-পরিবেশ-সংস্কৃতিগত পার্থক্য। এত পার্থক্যের বাইরেও মানুষে মানুষে মিলটাই কি বেশি নয়? আমার ঘরে আশ্রয় নেওয়া মেয়েটির নাম দিয়েছিলাম পাখি। একই প্রবৃত্তি দেখতে পাই আমার সমবয়সীদের মাঝে, গুরুজনদের মাঝেও। আমার ছোট চাচা চাচীকে তাদের রোম্যান্টিকপর্বে পাখি বলে ডাকতেন। আমার বাবাও কখনও কখনও ডেকেছেন মাকে। এটি আহ্লাদের ডাক। কিন্তু সাদিয়ার নামটা কেমন করে যেন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়ে গেলো।
তাই আজ আর কোনও কিছুতেই সাদিয়াকে সাদিয়া বলি না, সে একেবারেই পাখি হয়ে গেছে। আমার ছোটভাই বলে পাখি ভাবি, বড় আপু বলে লাবণ্য, ওর ছেলেমেয়েরা বলে পাখি মামী, ভাইয়া কখনও পাখি কখনও লাকি। আমার বাবা ডাকেন পাখি। তিনি ছেলের আদরের ডাকটার প্রতি সম্মান দেখিয়েছেন। মা ডাকেন লাকি। ফুপুরা মামারা পাখিই ডাকেন। কাজিনরাতো ডাকেই, উল্টো মজাও করে। আমার নানা ফোন দিয়ে বলেন কী খবর? পাখি কি আছে নাকি উড়াল দিছে...আমি মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম ও কখনও উড়াল দেবে না। তাই নানাকে বুকচিতিয়ে বলতাম পৃথিবীতে অতো বড় ডানা সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু আজ কি নানার সেই দুষ্টুমিটাই সত্য হলো?
একটা কন্ডিশনে ওকে ওর বাপের বাড়ি পাঠিয়েছিলাম। কন্ডিশন আর কি! কিছু টাকা যোগাড় করতে পাঠিয়েছি। ফ্ল্যাটের কিস্তি বাকী পড়ে আছে সাত-আটমাস। কর্তৃপক্ষ লালকালির চিঠি দিয়েছে; তাতে স্পষ্ট ঘোষণা দেয়া, ১৫ জুনের মধ্যে টাকা দিতে না পারলে ফ্ল্যাট বাতিল করতে বাধ্য হবেন তারা। তাই বাধ্য হয়ে আমিও ওকে চাপাচাপি করে বাপের বাড়ি পাঠিয়েছি টাকা আনতে। আমি জানি টাকা যোগাড় সে করতে পারবে না। ওর বাবা মা আমার চেয়েও ছ্যাচরা। আমাদের বৈবাহিক জীবনের এই প্রায় ৫টি বছরে কোনওপ্রকার দান-দক্ষিণা, গিফ্ট বা সহযোগিতার নিদর্শন নেই তাদের পক্ষ থেকে। অথচ নতুন সংসারের কতো ঝামেলা, কতো খরচ কতো বিপদাপদ যে হলো....সবটাই আমরা সামলেছি নিদারুণ কষ্ট আর বখিলি করে। ১২শ’ টাকায় একটা রুম ভাড়া নিয়ে ফ্লোরে ইউনিভার্সিটি লাইফের ফোমটা বিছিয়ে ঘুমিয়েছি। পিঁপড়া আর তেলাপোকার পাশাপাশি নিচতলার স্যাতসেতে মেঝের সব ঐশ্বর্যই আমরা তিল তিল তিল করে উপভোগ করেছি। আমাদের এ সংগ্রাম দেখে মুগ্ধ হতেন প্রতিবেশীরা। দরজা খুলে রাখতেন; আমি ফিরেছি টের পেলে একবোতল ফ্রিজের ঠাণ্ডা পানি অথবা খবরের কাগজ নিয়ে নিজে আসতেন কখনওবা পাঠাতেন মেয়েকে। সাদিয়ার খুব সঙ্কোচ হতো। হওয়াটাই স্বাভাবিক। যে মানুষ বাবামার ভালোবাসা পায়নি সে কী করে অন্য অচেনা প্রতিবেশীর এমন ভালোবাসা সইবে? ওর এই সঙ্কোচটাকেও হয়ত তারা ভালো বাসতেন, হয়ত ভাবতেন-- মেয়েটা উচ্চবংশীয়া তাই কারও কাছে কিছু চাইতে সঙ্কোচ করে। এরইমধ্যে একদিন আমার মা এলেন ঢাকা। ভাইয়ার বাসায় উঠলেন। আমাকে ডেকে পাঠালেন, কিন্তু ভাইয়ার শর্ত ছিল আমাকে একা যেতে হবে, সাদিয়াকে নিয়ে আমি ওর বাসায় যেন না যাই। মা এভাবে বলতে পারেননি তাই বললেন রাতে ফিরতে দেরিও হতে পারে, তুই একা আয়। অথচ সাদিয়া মাকে দেখার জন্য ছটফট করছিল। হয়ত ভেবেছিল হাতেপায়ে ধরে তার রাগ ভাঙাবে।...
আমি গিয়ে জানি না কী করে মাকে কিছুটা প্রসন্ন করতে পারলাম। তিনি রাজি হলেন আমার বাসায় আসতে। ওই একরুমের বাসায়। হয়ত নিজচোখে আমার সংগ্রাম দেখার লোভ হয়েছিল তাঁর। মা এলেন মানে পুরো পৃথিবী এলো। এলো স্রষ্টার সব অনুগ্রহ আর ক্ষমা। মা-বাবা রুষ্ট ছিলেন তাই হয়ত এতোদিন স্রষ্টাও শাস্তি দিলেন। মা মেনে নেয়া মাত্র স্রষ্টাও মুখ তুলে তাকালেন। ওই মাসেই আমার চাকরিতে জয়েন, তারপর নতুন বাসা নেয়া...সুখ-দুখ আর চাকরির নতুন সংগ্রামে সময় কাটানো...এভাবেই ৫টি বছর প্রায় হতে চলল।
একসময় এতাকিছু সহ্য করেছি! কিন্তু আজ যখন ফ্ল্যাটের এত বড় সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে তখন কিছুতেই আর মেনে নিতে পারছি না। সংগ্রাম আর কতো! আমরা কি কোনওদিন একটু ভালো থাকতে পারবো না? একটু ভালোভাবে বাঁচবার স্বপ্ন দেখতে পারবো না? দু’দুটো চাকরি করে ফ্যামিলির হাল বইতে বইতে ক্লান্ত যখন তখনও কি একটু সহযোগিতা করবে না কেউ?.... সব ক্ষোভ ঝারলাম ওর ওপর। তোমার জন্যই আমার জীবনে কিছু হলো না।...
আমার ছাত্রীরা কেন আমাকে ফোন করে, কেন আমার ফ্ল্যাটবুকিং এর সময় এতোগুলো টাকা ঋণ দিল, অমুক ছাত্রী কেন এত ফোন করে? ওর এসব ঠুনকো জেলাস আমাকে এতো বেশি পীড়িত করে....তাই এবার পাঠালাম নিজের বাপের কাছ থেকে পারলে চারআনা যোগাড় করো....কিন্তু আমি জানি এই চ্যালেঞ্জে সে জিততে পারবে না। মাঝ থেকে আমাকে সইতে হবে তার এবং তার ছেলের বিচ্ছেদ!
সপ্তাহ না যেতেই আমার ভেতরের সবগুলো কুঠুরি খা খা করে ডাকছে ওদের। জাবির কই তুমি? বাবার কাছে আসো না কেন? বাবাকে ডিস্টার্ব করো না কেন? কোথায় সেসব চিল্লাচিল্লি, রাগ টেনশন আর ব্যস্ততা? যে চাকরিটাকে মনে হতো এতো ভার এখন তার অবকাশটাই যেন সবচেয়ে বিরক্তিকর!
আর ফ্ল্যাটের টাকাটা ম্যানেজ হওয়াতেই যেন আরও বেশি উপলব্ধি করছি নিজের নিষ্ঠুরতা। একজনকে ম্যাসেজ দিয়েছিলাম সে যে চুপচাপ টাইমমতো এতোগুলো টাকা জমা দিয়ে দেবে তা কি ভাবতে পেরেছি? মুখে বলতে লজ্জা হচ্ছিল, তাই কোনওরকম একটা দায়সারা মেসেজ দিই। সে কোনও রিপ্লাই করেনি বলে ধরে নিয়েছিলাম দিতে পারবে না। কিন্তু টাকাটা জমা দিয়ে যখন ফোন দিয়ে বলে কাল পারিনি হরতালের জন্য...তখন বিস্মিত যতোটা হয়েছি তেমনি কৃতজ্ঞতায় বুক ভরে গেলো। মানুষ এখনও কতো ভালো....আর আমি? কেন ছ্যাচরা হতে গেলাম শ্বশুরবাড়ির কাছে? তারা যদি দেবারই লোক হতেন তাহলেতো মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে নিজেরাই বলতেন এই নে...বিয়েতেও তোর জন্য কোনও খরচ হয়নি...কিছু দেয়াও হয়নি...এইটা নে, ভবিষ্যৎ গড়। যখন তা বলেইনি কেন ছোট হতে গেলাম গায়েপড়ে?
পাখি তুমি ফিরে আসো। তোমার টাকা আনতে হবে না। যে ফ্ল্যাটে দুজন সুখে-শান্তিতে থাকবো বলে এতকিছু, সুখই যদি না থাকল তো ফ্ল্যাট দিয়ে কী হবে? এবারও মুখ তুলে তাকালেন আমার ভাই আমার বাবা আমার বন্ধু-স্বজন। এরপরও তুমি তোমার বাবা-মাকেই বেশি সাপোর্ট করবে, তুলে ধরবে তাদের দারিদ্রচিত্র! এই আশাই করি। কারণ পৃথিবীতে মেয়েরাই সবচেয়ে বেশি অকৃতজ্ঞ হয়।
শিল্পী তুহিন এবং তোমার ভাই তুহিনের প্রিয় গানটাই আজ ভিখিরির মতো আমাকে দিয়ে বলায়
‘সূর্যের বুকে আছে যতটা আলো
তারও বেশি তোমাকে বেসেছি ভালো
ভালোবাসি বড় ভালো বাসি এর বেশি ভালো বাসা যায় না
ও আমার প্রাণপাখি ময়না’।
সে রাতে আর যা-ই বলি অন্তত গায়ে হাততো তুলিনি,
এইটুকু ভেবে যদি ফিরে আসো, কথা দিচ্ছি এই সংসারের অনটনের জন্য আর কখনও তোমাকে কষ্ট দেবো না। তোমার, তোমার বাবা-মার কথাই ঠিক এ সংসার আমার। আমার সংসারে এসে তুমি অনেক কষ্ট সয়েছ। কেন সইবে? তুমিতো কেয়ারটেকারমাত্র। মেয়েরা পরের ঘরে যায়, পরের সংসার করে নিজের সংসার গড়ে না। তোমাদের এই চিরন্তন চিন্তা-চেতনা নিয়ে আর কোনও খেদ নেই। জানি আমার বুকে ফিরে না এলেও ফেসবুকে তুমি ঠিকই আসবে, যদি এই চিঠিটা পাও একটা উত্তর অন্তত দিও।....
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন