Zabeer BirthDay
রাত তখন ১২টার একটু বেশি; খুব ঘুম পাচ্ছিল, অফিস থেকে ফেরার পরপরই। নামাজ না পড়েই ঘুমিয়ে পড়লাম। তার আগে শ্বশুরবাড়িতে থাকা আমার স্ত্রীকে বললাম ও ঘুমানোর আগে যেন আমাকে একটু উঠিয়ে দেয়। এশা’ এবং তাহাজ্জুদ একসঙ্গে পড়তে পারবো। সত্যি সত্যি রাত দু’টোর দিকে আমার ফোনটা বেজে উঠলো
হ্যাঁ বলো!
উঠছ?
হুম!
নামাজ পড়ো।
আচ্ছা বলে আমি ফোন রাখি।
নামাজ কিছু শেষ, কিছু বাকী; ফোনটা আবার বেজে উঠলো।
হ্যালো! কী ব্যাপার?
ফোনটা একটু মামণি কে দিবা?
কেন? আম্মা ঘুমাচ্ছে।
দেওনা! আমার যেন কেমন লাগছে।
এটা কোনও ব্যাপার না, এসময় সবারই এমন লাগে। পেটের ভেতর বাবুটা নড়ছে হয়ত!
নাগো খুব ব্যথা করছে। আর...
এতো রাতে আম্মার ঘুম ভাঙতে পারবো না।
কিন্তু এ কথাতেই যেন আম্মার ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুমজড়ানো কণ্ঠে জানতে চাইলো কার ফোন? দে আমাকে দে
পরের কথাগুলো আমার মায়ের সঙ্গেই হলো। তিনি বুঝলেন এটি কোনও মামূলি ব্যাপার না। বরলেন তোমার মাকে ফোন দেও, এখনি হাসপাতালে নিতে হবে। আমার নামাজ ততক্ষণে শেষ। আমি উৎকর্ণ হয়ে শুনলাম মুরুব্বিদের কথা। লাকি কে হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা হলো। গাড়ির ড্রাইভার যে হাসপাতালে নিতে বললো তাতে খরচ কম লাগে তাই লাকির তাতে আস্থা নেই। ও যাবে মা ও শিশু হাসপাতালে। তা-ই নেয়া হলো। পরিচিত ডাক্তারদের নাম্বারে ফোন দিয়ে কাউকেই পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই ফোন বন্ধ করে ঘুমাচ্ছে। পরিচিত একজন নার্সের নাম্বার খুঁজে পাওয়া গেলো। ‘রাজিবের মা’। আপন আত্মীয়ের মতো তিনিই সব ব্যবস্থা করলেন এমনকি ডাক্তাররা যখন সিদ্ধান্ত নিলেন সিজার করবেন তখন এই নার্সই বললেন এসব ভাওতাবাজি, টাকার জন্য পেট কাটে। আপনারা রাজি হইয়েন না। আমার কাছে জানতে চাওয়া হলো; আমি বললাম যেটা ভালো হয় সেটা করো। তীব্র পেইনের জন্য ওয়েট করতে করতে ১২টা বাজলো। লাকি তখন অস্থির, আর সহ্য করতে পারছে না, এদিকে সাদা ব্লিডিং হতে হতে পানিশূন্যপ্রায়। ডাক্তারও বললেন আর ঘণ্টা খানেক দেখা যেতে পারে এর বেশি না। অবশেষে ওটিতে নেয়া হলো। দুপুর দু’টোর দিকে ছোট্ট কাটাকুটির পর বেরিয়ে এলো একটি মানব সন্তান। আল্ট্রাসনোতে দেখা ছেলে সন্তানই এলো পৃথিবীতে। সংবাদটা আমাকে ফোন করে সবার আগে দিল ছেলের মা নিজেই। অর্থাৎ সে সম্পূর্ণ সুস্থ। আমার সমস্ত শরীর ভেঙে আসছিল রাতের কথা মনে পড়ে। যদি না নামাজ পড়তে উঠতাম! যদি না মা ফোনটা কেড়ে নিতেন! যদি না নার্স খালাকে পাওয়া যেত, যদি না গাড়িটা তখন পাওয়া যেত....সবই কি আল্লাহ তার নিজের কুদরতে করলেন না? গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন তার এক বান্দাহ গভীর রাতে তার কাছে প্রার্থনা করবে আর তিনি তা শুনবেন না তা কী করে হয়?
ডাক্তার বললেন ইনকিউবেটরে রাখতে হবে। বাচ্চা খুবই অপুষ্ট। আট মাসের বাচ্চা, অপুষ্টতো হবেই। মাথায় কোত্থেকে যে এতো ভয় আর টেনশন জড়ো হলো জানি না। কিন্তু একটু পরই আবার তা উবে গেলো। মহান আল্লাহর কুদরতের কথা মনে পড়ে। একটু পর আবার ফোন....বাচ্চাকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে, কিন্তু বেবি একেবারেই সুস্থ। তার নড়াচড়া তথা দুষ্টুমি দেখে ডাক্তাররা খুবই মুগ্ধ। কোনও কৃত্রিম ব্যবস্থা ছাড়াই সে সুস্থ হয়ে উঠবে এমনটিই আশা করছেন সবাই। ইনকিউবিটরে রাখার কথা শুনে দারুণভাবে বিচলিত হয়ে ওঠে আমার ছোটভাইটা। বাবাকে ফোন দিয়ে বলে আপনি যেখান থেকে পারেন টাকা ম্যানেজ করে ফরিদপুর হাসপাতালে চলে যান।
বাবা সব প্রস্তুতি নিয়ে আমাকে ফোন দেন, আমি রেডি, নাতীকে দেখতে যাবো, কীভাবে যাবো? এখন কি কোনও গাড়ি পাবো, নাকি কাল সকালে রওনা হবো? আমি বললাম পরিস্থিতি ভালোর দিকে, এই অবেলায় অচেনা যায়গায় আপনি রওনা করে আরেক টেনশনে ফেইলেন না। ঢাকা থাকলে একসঙ্গে যেতে পারতাম।
আমার তখন মিটিং চলছে। চেয়ারম্যানের সঙ্গে। পরে আমাদের ব্যক্তিগত সাক্ষাতকার আছে। চাকরি পারমানেন্টের সাক্ষাতকার। মনজু ভাই এবং মাহবুব স্যার কড়া ধমক দিলেন এখনও কেন গেলাম না। অফিসের গাড়ি নিয়ে ব্যাংকে গেলাম, টাকা তুললাম তারপর গাড়ি বুকিং দিয়ে পরদিন সকালে রওনা করে দুপুর নাগাদ পৌঁছলাম ফরিদপুর। জন্মের পুরো ২৪ঘণ্টা পর দেখতে পেলাম আমার সন্তানের মুখ এবং তার মায়ের বিজয়ী হাসী। হাসপাতাল থেকে বেরুতে বেরুতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। গাড়ির জানালা খুলতে দিল না ড্রাইভার মামা। ওর মাও বললেন জানালা খোলা যাবে না। কিন্তু তাতেই যেন বাবুর নি:শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। অল্প সময়ের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম লাকির মামা বাড়ি তাম্বুলখানা। এই প্রথম আমার মনে হলো এটি একবারেই অজপাড়াগাঁ। কেমন ঘুটঘুটে অন্ধকার, লোডশেডিং এর মাত্রা ভয়াবহ! ইলেকট্রিসিটি থাকে না বললেই চলে। বাবুর রুমের দরজা-জানালা বন্ধ থাকলে ফ্যানের বাতাস বন্ধ থাকলে যাচ্ছেতাই বিরক্তিকর পরিবেশ তৈরি হয়। কী করা উচিৎ বুঝতে পারি না। চরম সতর্কতায় তিনদিন পার করতে হয়, তারপর ৫হাটুরা, তারপর সাতদিনের ধাক্কা, এরপর ২১ দিন গেলে পরিস্থিতি একটু ভালো কিন্তু এই ২১দিনের মাথায়ই দেখা গেলো বাবুর সমস্ত শরীর হলুদ। আমার টেনশনে মরোমরো অবস্থা। কিন্তু আশা জ্বালিয়ে রাখে সেই স্রষ্টা, যিনি এতো কুদরত দেখালেন! সবকিছু ঠিকঠাক মতো করালেন...তিনি কি...চোখ ফেটে আসে অশ্রুতে। মুরুব্বিদের ফোন দেই। তারাতো অনেক ষন্তান পালন করে অভ্যস্ত। টের পাই অভিভাবক কী জিনিস। মা বলেন এটা কোনও সমস্যা না। সকালের রোদে বের করতে বলিস...আপা বলে ওর ছেলেরও এমন হয়েছে রোদ লাগালে ঠিক হয়ে যায়, আল্লাহর ইচ্ছায় তাতেই ঠিক হয়ে গেলো। এরপর চল্লিশ দিন; এভাবে মাস, বছর কেটে কেটে আজ (৩০ এপ্রিল) তিনবছরে পা দিয়েছে সেই ছোট্ট বাবুটা...তার ৩য় জন্মদিনে তাই শুধুই দোয়া ভিক্ষা চাই শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছে।
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন