খরগোশ মারার শাস্তি!

পাখি একদিন হুটকরে কী মনে করে একজোড়া খরগোশ কিনে আনলো রাস্তার পাশে; বাজার থেকে। ও খুব ভয়ে ছিল; আমি কী বলি তাই নিয়ে। কিন্তু খরগোশ দুটো দেখে আমার ভালো লেগে গেলো। ও জানতে চায়- রাগ করোনাইতো? আমি বলি না। কত নিছে? বেশি না, ২টা ৫০টাকা। আমাদের যা সংসার তাতে ৫০টাকাও অনেক বড় অপব্যয়। তবু জাবির খেলবে এমন আশাতেই মেনে নিলাম। আর পাখির মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতেও মায়া লাগছিল। নিজের খাওয়ার জন্য কিছু আনেনি, সখের জন্য দু’টো খরগোশ এনেছে। আমি উঠেপড়ে লাগলাম খরগোশের থাকার যায়গা নির্মাণের জন্য। এটা দিয়ে সেটা,সেটার সাথে ওটা ইত্যাদি করেও যখন হচ্ছিল না তখন অফিস থেকে উদ্বৃত্ত ককশিট কুড়িয়ে এনে তাই দিয়ে একটা ছাদঅলা বাড়ির মতো গড়ে দিলাম বেচারা খরগোশকে। আর পাখিতো তিনবেলা খাওয়া শ্যাম্পু দিয়ে গোসল, বাজার থেকে ওদের পছন্দের খাদ্য পাতাকপির পাতা কুড়িয়ে চেয়ে-চিন্তে এনে দেয়ার কাজেই লেগে থাকে অনেকটা সময়।
কিন্তু এরইমধ্যে সময় হয় ঈদুল আযহার। বাড়ি যাব না বললেও শেষমেস আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। যখন দেখলাম ভাইয়ারা সবকিছু নিয়ে রেডি! তখন ভাইয়াদের কষ্ট হবে জেনেও বের হয়ে গেলাম ওদের সাথে। আমি অবশ্য আগেই চলে এলাম অফিসে, সেখান থেকে লঞ্চঘাটে। পাখি ভাইয়াদের সাথে এলো, কিন্তু ভুল করে ফেলে এলো খরগোশ দুটোকে। লঞ্চে এসে সুন্দর কেবিন-টেবিন পাওয়ার পরও যখন কিছুতেই ওর মনে আনন্দের চ্ছটা দেখতে পাচ্ছি না তখন আমার কেমন যেন সন্দেহ হলো। খুব ঘনিষ্টভাবে জানতে চাইলাম-
ভাইয়াদের সাথে আসতে কোনও সমস্যা হইছে?
না, তাইলে মন খারাপ কেন? এমনি।
ও বলতে চায় না আমি পীড়াপীড়ি করাতে বলে- খরগোশদুটোকে মনে হয় করিডোরে ফেলে এসছি।
মনে হয় মানে? তুমি কি আনছ?
না, আনার জন্য রেডি করেছ? না
তাহলে? ওরা কি বিড়াল যে তোমার পিছপিছ এসে গাড়িতে উঠবে?
ভুল হয়ে গেছে...
এটা কেমন ভুল? দুটো প্রাণী ১০দিন না খেয়ে থাকবে কী করে? খাওয়া না পেয়ে কিঁউ কিঁউ করবে, খাবার না পেয়ে কেমন ছটফট করবে....একবার ভাবোতো আমাদের জাবির যদি খাবার না পেয়ে ছটফট করে কেমন লাগবে? ইশ দুটো বাচ্চা!...
এখন কী করা যায় তাই বলো?
আমার খুব রাগ লাগে। বোবা দুটো প্রাণীকে এভাবে হাতে ধরে মেরে ফেলার কোনও অর্থ হয়? এককথা দুইকথা তারপর ঠাশ করে চড় বসিয়ে দিলাম পাখির গালে। ও যেন এটারই অপেক্ষায় ছিল। একদিকে খরগোশের কষ্ট অন্যদিকে চড়, ব্যাস শুরু করলো সব কান্না একসাথে...লঞ্চে যাত্রীতে ঠাসাঠাসি। তারাও টের পেয়ে গেছে ব্যাপারটা। ও কাঁদছে আর বলছে আমি এতোদিক একা কীভাবে সামলাই?
একা না পারলে  আরও কয়েকটা (....) বানাইয়া নে, তোরতো দুনিয়ায় মা-বাপ-ভাইবোন কেউ নাই। মিশুকেতো ওর ভাই উঠায়া দিয়া গেছে, কেবিন ভাড়াও দিয়ে গেছে, তোর আছে কেউ দুনিয়ায়? (....) স্বামীর ঘাড়ে সব চাপাইতে চাস লজ্জা করে না?
মানুষের মাথা যখন গরম থাকে তখন নাকি বুদ্ধি লোপ পায়। কিন্তু আমার মনে হয় বুদ্ধি লোপ পায় বলেই মানুষের মাথা গরম হয়। জিজ্ঞেস করলাম বাসার চাবি কই? পাখি বলে একটা ওর কাছে আরেকটা বাসায় আলমারির মধ্যে একটা মগের ভেতর। আমি বললাম বাসার গেটের চাবিতো একটা বাড়িঅলার কাছে থাকে, দেখ কেউ খরগোশ দুটোকে দশদিন পালার দায়িত্ব নেয় কি না। নাম্বার আছে কারও?
না,
তা থাকবে কেন, এতো পিরিত আর নাম্বার নাই? দুইতলার আপুকে বল...
আপুরাও বাড়ি গেছে।
তাইলে মর, ওখানে খরগোশ দুটো না খেয়ে মরুক, আর তুই মজা মাইরা কোরবানীর গোশত খা। তোর মতো পোড়াকপালীর সখ থাকতে নেই।....ও বিকল্প প্রস্তাব দেয়, ভাইয়াদের কাছে দেখ বাড়িঅলার নাম্বার আছে কি না, বাড়িঅলার নাতি নোহার খুব শখ ওগুলো পালার। আমার কাছে একটা চাইছিল। আর ওদেরতো খাঁচাও আছে। ভাইয়ার কাছ থেকে বাড়িঅলার নাম্বার নিয়ে নোহাকে পাওয়া গেলো না। লঞ্চে নেট পাওয়া খুব কঠিন। রাত নয়টার দিকে বোধয় পেলাম। নোহা আর ওর মা আমাদের বাসা খুলে ডাইনিং স্পেসে রাখা আলমিরা থেকে রুমের চাবি নিয়ে খরগোশদ্বয়কে উদ্ধার করলো। এই খবর পাওয়ার পর মনটা একটু শান্ত হলো। দুটো প্রাণীকে বাঁচালেন স্রষ্টা।
আমরা ঢাকা ফিরে এলাম ১৫দিন পর। ততদিনে খরগোশ দুটো দিব্যি আরামে আছে। ওদের যেহেতু খাঁচা আছে আর যত্নও হচ্ছে ভেবে আর বাসায় আনা হলো না। জাবির হাতের কাছে পেলে এমন শক্তকরে ধরে বেচারাদের আত্মারাম খাঁচাছাড় হয়ে যায়। আবার নোহা এতদিন কষ্ট করে পালছে, এখন নিয়ে এলে কষ্টই পায় নাকি! সবদিক ভেবে ওগুলো ওপরেই থাকলো। কিন্তু এরমধ্যে একটাকে বিড়াল কীভাবে যেন বধ করে ফেলল। জাবিরের সে কি কান্না! ওর একটা খরগোশ নাই এই লোমহর্ষক ঘটনার বিবরণ দেয় আর কাঁদে। কষ্ট আমিও পেলাম। কতো অসহায় জীবন! হয়ত চিৎকার করেছে কেউ বাঁচাতে আসেনি। বিড়ালটা খেয়ে মেরে ফেলে রেখেছে।...
Text Box: বিকল্প খরগোশঅন্যটাকে এনে আবার আগের যায়গায় রাখলাম। পাখি একটু বিরক্ত। এটা নড়াচড়া করে কম। সঙ্গীর জন্য শোকাহত! হয়ত সেকারণেই। তাছাড়া নিয়ম করে বাজার থেকে পাতাকপির পাতাও আনা হয় না। এদিকে সে নিজেও একটু অসুস্থ হয়ে পড়ে। খরগোশের যত্ন কমে যায়। একরাতে আমি অফিস থেকে ফিরে জিজ্ঞেস করি খরগোশটাকে কিছু খাওয়াইছ? ও বলে ভাত দিছি, ভাততো খায় না অন্যকিছু দেও! ও বলে দেখি দিনে কিছু এনে দেবো...কিন্তু রাতেই আমার কেন যেন মনে হলো ছোট্ট খাঁচায় খরগোশটা ছটফট করছে...সেকি শুধু সঙ্গী নাই বলে? নাকি খিদের জন্য বুঝতে পারিনি।...বুঝে ওঠার আগেই সকালে উঠে দেখি ভাতের সামনে মুখ রেখে মরে পরে আছে খরগোশটা। খুব আফসোস হলো! আমরা খরগোশটাকে না খাইয়ে মেরে ফেললাম!....
ইদানীং কথাটা খুব মনে পড়ে।
পাখি এখন প্রায়ই না খেয়ে থাকে। বেতনের সবটা দিয়ে দিয়েছি ফ্ল্যাটের কিস্তি শোধ করতে। ওকে বলেছি এ মাসটা যেভাবে হোক যার থেকে পারো হাওলাত নিয়ে চালাও। ও কার কাছ থেকে হাওলাত নেবে? নিলেইতো হবে না, দিতেতো হবে। আমি নিজেই ঋণ করেছি চল্লিশ হাজার। ও গতমাসে এরওর থেকে নিয়ে মাসের শেষদিনগুলো কোনওরকম পাড় করেছে। কিন্তু এখন? খাবার মেন্যু দিনদিন যেখানে গিয়ে ঠেকছে তাতে আমার মনে হয় ওও খরগোশের মতো না খেয়ে মরে যাবে। হয়ত এটাই ওর শাস্তি। খরগোশ পালতে আনার শাস্তি! ডালের দাম বেড়েছে তাই আলু ঘণ্টকে ডাল হিসেবে খাচ্ছে। মাছগোশতের দেখা নেই অন্তত বিশদিন হয়ে গেছে। দুয়েকটা ডিম আনতে পারলে তাও জাবিরকে দেয়া হয়। ও তো এখন কিছুই খেতে পায় না, তাই চারটা ভাতই খায়। হরলিক্স বন্ধ করে কিছুদিন শুধু দুধ দেয়া হতো, তাতে নাক শিটকালেও একসময় খেতে শুরু করে। এখন দুধটাও বন্ধ।...খরগোশটাকে না খাইয়ে মারার শাস্তিই কি দিচ্ছেন আল্লাহ! কিন্তু আমরাতো খরগোশ নই যে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারি না। আমাদেরতো প্রার্থনা করার ক্ষমতা আছে-ছোটবেলায় প্রার্থনা করতাম ‘রব্বি জিদনি ঈলমা’ প্রভূ আমার জ্ঞান বাড়িয়ে দাও! আর এখন প্রার্থনা করি প্রভূ আমার বেতন বাড়িয়ে দাও....অন্তত হাসিনার আমলের এই চরম দ্রব্যমূল্যের যুগে না খেয়ে মরার আগে-একটু খেয়েপড়ে বাঁচার মতো বেতন বাড়িয়ে দাও!


কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.