আসসালাতু খাইরুন মিনান-নাউম....


আসসালাতু খাইরুন মিনান-নাউম.... আযানের এ ধ্বনিটুকু শোনা হয় না ইদানীং চাকরির বদৌলতে স্রষ্টাকে ভুলে থাকার একটা অজুহাত পেয়ে গেছি। রাত বারোটায় ফেরার পর ঘুমুতে ঘুমুতে বাজে রাত দুটো। টেলিভিশন অথবা কম্পিউটার বেশ সাহায্য করে রাতকে আরও গভীরতর করতে। মাঝে মাঝে; বিশেষকরে বৃহস্পতি ও শুক্রবার, রাত করিয়ে দেয় এফ এম। দুটি এফএম স্টেশনের জনপ্রিয় ২টি অনুষ্ঠান থাকে ওসব দিন। ভুত আর ভালোবাসা। সো, সকালে ওঠার অভ্যেস একেবারেই গেছে। যতোটা বেলা করে ওঠা যায় ততই যেন আভিজাত্য বাড়ে অনুভূতিতে। আসলে কী বাড়ে আর কী কমে হিসেব করা হয় না এখন। যেন অনেক বেলা ঘুমানোটাই শ্রেষ্ঠ স্বাধীনতা শ্রেষ্ঠ সুখ। খুব মায়া হয় স্কুলের মর্নিং শিফটের বাচ্চাদের জন্য। কতো কষ্ট দেয় ওদের বাবা মা। কী লাভ? এতো কষ্টের পড়াশুনা করে? ফাহিমও চাইতো না রোজ রোজ স্কুলে যেতে। ভয়ে পাংশুটে হয়ে যেত ওর চোখ-মুখ, পরীক্ষার ডেট দিলে। বাবা-মার প্রত্যাশিত ভালো রেজাল্টের জন্য মাঝে মাঝে মরে যেতে ইচ্ছে হতো ওর। সে কথা বলেওছিল বাবা-মাকে। কিন্তু আধুনিক বাবা-মায়েরাকি পারে এতোটা খামখেয়ালী হতে? তাই চেষ্টার পর চেষ্টা আর স্বপ্নের পর স্বপ্ন চাপিয়ে দিত ক্লাস ওয়ানের শিশু ফাহিমের ওপর। ফাহিম কিন্তু মুক্তি পেয়ে গেছে...ঠিক বার্ষিক পরীক্ষার আগেই। এমনকি তৃতীয় সেমিস্টার পরীক্ষার ফলাফলটাও সে জেনে যেতে পারেনি। রেজাল্ট আনতে গিয়েছিল ফাহিমের মা। তারই যাওয়া উচিৎ। পড়ালেখাটোতো ছিল তাদেরই। অতো পড়ার সাধ ফাহিমের কোনওকালেই ছিল না। ওতো চাইতো নানু বাড়ি বেড়াবার স্বাধীনতা, চাইতো বনশ্রীর ফাঁকা সবুজ প্লটে সারাদিন দৌড়ে বেড়াতে আর... আর একজোড়া কবুতরের খুব সখ ছিল, বাবার কাছে একটা হাতুড়িও চেয়েছিল ক্ষুদে বালক। হয়ত দেয়ালে পেরেক ঠুকে মিকি-মাউসের ছবি লাগানোর জন্য! ফাহিমতো মুক্ত! কিন্তু আরও কতো শিশু প্রতিদিন বলি হচ্ছে বাবা-মার ইচ্ছা আর স্বপ্নের কাছে। আমাকেও বলি দিতে বলে ওরা। স্যার আপনার ছেলেকে স্কুলে ভর্তি করান! এমনকি ওর নানা-নানু, মামারা খুব অবাক হয়! কী সারাদিন ছেলেকে নিয়ে আহ্লাদ করেন! ওরতো এখন পড়ার সময়। আমি আগে হেসে উড়িয়ে দিতাম, এইতো আরেকটা বছর পর। আরেকটা বছর কেটে যাবার পর এখন বিরক্ত হই সেইসব শুভাকাঙ্ক্ষীদের তাড়নে। যারা নিজেরাও দাবি করে ‘ওর ভালো চাই বলে’। ওর ভবিষ্যতের জন্য... ওর ভালো ভবিষ্যতের জন্য ঢাকা নামক সোনার শহরে একখানা ফ্ল্যাট বুকিং দিয়েও শেষ অব্দি রক্ষা করতে পারিনি মাসিক কিস্তি আর সংসারের টানাপোড়েনের জন্য। মাত্র বছর তিনেক পর যার মূল্য দাঁড়াত কোটি টাকা; আনুমানিক। যাকে অবলম্বন করে ছেলেকে অষ্ট্রেলিয়া পড়তে পাঠাবার প্ল্যান ছিল আমার। মাত্র একলাখ টাকা ঋণ দিতে যাদের দয়া হয়নি তারাকি সত্যিই ভালো চায় আমার অথবা আমার ছেলের? অতটুকুন ছেলের ল্যাপটপের খুব শখ। কেউ কিনে দেয়নি। ছেলের শখ পুরণের দায়িত্ব শুধুই নাকি বাবা-মার। হ্যা, আমি পেরেছি। ভবিষ্যতকে আঁধার করে হলেও ওর বর্তমানের চাহিদা মেটাবার সাধ্য হয়েছে আমার। তাই আর কোনও শুভাকাঙ্ক্ষীর বুদ্ধি বা পরামর্শ আমি চাই না। ঠিক করেছি ছেলেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াবো। যেখানে পড়ার চাপ কিছুটা হলেও কম। যেখানে স্কুলের সাথে থাকবে বিশাল মাঠ। তপ্ত রোদে খেলা করে, টিউবঅয়েল চেপে বিশুদ্ধ পানি পান করবে। বিষাক্ত জুস খাবে না। যেখানে ওর ওপর ভেঙে পড়বে না নির্মাণাধীন দেয়াল। ফাহিম, খুব কষ্ট পেয়েছিলে তুমি? কংক্রিটের আঘাতে তোমার রোগা শরীরটা দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল। নাকে-মুখে ছিল রক্তের গড়াগড়ি। ফাহিম তুমি কি শেষবারের মতো চিৎকার করে কাঁদতে পেরেছিলে? নাকি দুষ্টুমি করার অপরাধে স্যার বকে দেবে সেই ভয়ে রা-টাও করোনি? ফাহিম পনের-বিশমিনিট টিফিনের ফাঁকে কীইবা এমন খেলতে তুমি? কাড়ি কাড়ি টাকা যারা নেয় পড়াবার নামে তারা কি পারত না খেলার জন্য কিছু রাখতে? প্রভূ ! ওদের সব টাকা তুমি ধংস করে দাও। যারা পাঠশালাকে করেছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।.... প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে কিছুটা পথ হেঁটে রোজ স্কুলে যাবে আমার ছেলে। শিশুদের উপযোগী পাঠদান পদ্ধতি জানা সামান্য জ্ঞানের বিএড টিচাররা শেখাবে ক-খ। এইটুকু আমি চাই। বড় বিদ্বান বানাবার লোভে মায়ের কোল থেকে ছিনিয়ে এই ঢাকা শহরে ফেলে রেখে গিয়িছিল আমার বাবা। ক্লাস সেভেন থেকে মাস্টার্স অবধি একাকিত্বের সবটুকু ঐশ্বর্য ভোগ করে বেড়ে উঠেছি তাই, ছেলেকে সে কষ্ট দিতে চাই না। আজও কি পেরেছি ফিরে যেতে সেই বাবা-মার কাছে? হয়ত ফেরা হবে না কোনওদিন।.... ছোটবেলায় শিখেছি গোয়িং টু স্কুল হয় কিন্তু গোয়িং টু হোম হয় না। ভাবতাম কেন? আজ তার উত্তর জানি। বাড়িতে কেউ যায় না, বাড়িতে সবাই ফেরে। কিন্তু আমারতো ফেরা হয় না।...আগে ঈদের ছুটিতে দিন কয়েকের জন্য বাড়ি যেতাম, ফিরতাম হোস্টেলে। এখনও কর্মজীবনের ফাঁকে দিন তিনেকের জন্য বাড়ি যাই, ফিরে আসি কর্মস্থলে।.... তাই যতোটা সুযোগ পাই ছেলেকে বুকে আগলে রাখতে চাই। প্রভূর ওপরতো কারও হাত নেই। বিদায় ঘণ্টা যেদিন বাজবে কেউ কি পারবে ফেরাতে? ছেলের ওপর তাই চাপিয়ে দেই না ভদ্র-সভ্য সমাজের ‘অতিশাসন’। খবরদার! গালি দেয়া যাবে না। খবরদার এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না....নানা নিষেধ আর হুমকি-সতর্কতার জীবন তাকে দিতে চাইনি। তাই ‘শরীফ’ ভাই-বোনেরা যতই কষ্ট পাক ছেলেকে চড়-থাপ্পর দিয়ে বাহাদুরি দেখাইনি। অমন দু-চারটে গালি আমরাওকি দিয়ে ফেলি না? ওতো ইলেকট্রিসিটি চলে গেলে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে সেই গালিটা দেয়...কির বাচ্চা....তাতে তুমি কেন লজ্জা পাও? ওর মাকে বুঝাই। যে মানুষেরা অল্প-দামে চাল ডাল কিনে চারটা মাছ ভাত খেয়ে জীবন-যাপনের সুযোগ দেবে বলেছিল, দেবে আরও কতো মহাসুখ! তারই লোভে বেধিছিল মহাজোট! তারাকি দিতে পেরেছে কিছু? তবুতো এতটুকু লজ্জা নেই! বরং উঁচুগলায় শহরের সবচেয়ে দামি মাইক্রোফোনে বলে বেড়ায় হেন করেছি তেন করেছি...লজ্জাতো তারই পাওয়া উচিৎ....ম্যাডাম আমার টিউশনি করে, যখন আমার বেতন তিরিশ, তবু হিমসিম খায় মাস চালাতে, একদিন যার ৮হাজারেও বেশ কিছু টাকা জমতো....মানুষ বেড়েছে মাত্র একজন, তাওতো শিশু....এবং দেখতে ফিলিপাইন অথবা তিববতীদের মতো ভূখা-নাঙা....তবু সংসার চলে না আপা...আর চলে না। ইলেকট্রিসিটি চলে গেলে ঘামাচিতে অতীষ্ট হয়, বেসিনের কাছে ধর্ণা দেয়, তবু এক ফোঁটা পানি জোটে না যার, সে যদি বিরক্ত হয়ে দুটো গালি দেয় ক্ষমা কি করা যায় না ম্যাডাম? নাকি জাবি’র টিচার কিংবা আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদের মতো তাকেও কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন? রাষ্ট্রদ্রোহী বলে? আপনি স্বাধীনতা এনেছেন অথচ বাঁধ ঠেকাতে পারেন না টিপাইমুখে। আপনার বাবাও পারেনি ঠেকাতে ফারাক্কা। কিন্তু আমি? ছেলেকে কিনে দিয়েছি ধারালো কেঁচি, যা দিয়ে সে কেটে ফেলে জানালার পর্দা, আমার বই, বিছানার গোলটেক্স চাদর, জিনসের প্যান্ট...আরও অনেক কিছু...শিশুরা শিখুক স্বাধীনতা কি....কারণ আপনার দেয়া অভাব আর ডালের টানে ছিঁচকে চোরেরা এর চেয়ে বেশি সর্বনাশ করেছে আমার। ৫৫ হাজারের আইফোন, সাড়ে সাতহাজারের নকিয়া মিউজিক এক্সপ্রেস...আরও কতো কিই নিয়েছে ওরা; গরমে খোলা জানালার ফাঁক দিয়ে.... আপনিতো কারও বেডরুম পাহারা দেয়ার দায়িত্ব নেননি, আপা! আপনি পেরেছেন ১৮ বছরের আগে কিশোরী মেয়েদের বিয়ে আটকাতে, কিন্তু রুমিরা ১৫ বছরেই প্রেমেপড়ে ২৬ টুকরা হয় লম্পট প্রেমিকের হাতে, আপনি কি পেরেছেন আটকাতে? একমাসে ৩৯৮ জন খুন হলেও আপনার বুক কিংবা ক্ষমতার দণ্ড এতটুকু টলেনি। মেসে থাকা ছেঁড়া কাঁথার যুবকেরা যখন এপিএস হয়ে তিনবছরে বনেযায় কোটি কোটিপতি তখন ভাবতেই হয় আপনি চাইলে অনেক কিছুই পারেন। পারে আপনার মন্ত্রীরাও। তবে আমি কেন পারবো না। আমার পরিবার আমার সাম্রাজ্য....দিক না গালি সেই নোংড়াভাষায়....হয়ত বাসড্রাইভার টেম্পুর হেল্পার অথবা রিক্সাঅলার কাছে গালি শেখা ছাড়াও শিখবে অনেক কিছুই; জীবনের জন্য যা বইতে পাবে না কোনোদিন। আমি তাই স্বাধীনতা দিতে চাই। ফাহিম! তোমার বাবার আর্তনাদ আমার চোখ খুলে দিয়েছে...ছেলেকে নিয়েগিয়েছিলাম আইডিয়েলে ভর্তির জন্য। ওরা একলাখ চায়, উন্নয়নকাজে....মানে ফয়েজুর রহমানের মতো দেয়াল তুলবে? ভেজাল সিমেন্ট দিয়ে? না আমি তা পারবো না। আমার টাকায় ওরা খুন করবে কোনও না কোনও শিশুকে! আমার পেশা শুনে মতলব পাল্টে যায় ওদের। মুখোশ পাল্টায় না।...হে প্রিয় নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তোমার কপালে থু...থু তোমার এপ্লাস সাফল্যের প্রতি। লোডশেডিং শুরু তাই ক্ষান্ত আজ এখানে...মিনিট পাঁচেক ব্যাকআপ...তার আগে....

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.