নির্জন রাতের প্রহর মুগ্ধ বারতা...

নির্জন রাতের প্রহর মুগ্ধ বারতা...
হাল ভেঙে যে নাবিক চলে আপন সাগরে...

এখন একটা কাজ করি। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় মাস্টার্স করে ঢাকায় আসি; কাজের সন্ধানে কতোখানে কত জনের কাছে যে ধর্না দিলাম! শেষে এই কাজটার সন্ধান পেলাম। ডাটা এন্ট্রির কাজ। একটা মেডিসিন কম্পানির কাজ। কাজের নেচার একটু ভিন্ন। রাতে কাজ করতে হয়। ১১টা থেকে ভোর ৭টা পর্যন্ত। ক্যম্পাসে থাকতেই রাতজাগার অভ্যেসটা করেছিলাম তাই খুব একটা সমস্যা হয় না। তবে ভোরের দিকে ৪টা৫টা বাজলে তামাম পৃথিবী যেন উর্টে যেতে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যে গ্যাসের খনি উথলে ওঠে, স্কিনপ্রদাহ বাড়ে, আরও কিছু সমস্যা হয়। মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে। কাজ এলোমেলো হয়ে যায়। করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি ঘড়িটার দিকে, যদি দয়া করে একটু তাড়াতাড়ি ৭টা বাজিয়ে দেয় ঘড়িটা!
বাসায় ফিরে; মানে মেসে এসে ঘুমের চেষ্টা করি। কিন্তু ততক্ষণে সূর্য উঠে যায়। চামড়ায় চিটচিটানীটা বাড়ে। মেজাজ ক্রমশ: খিটখিটে হতে থাকে। নয়টায় খাবারের ডাক আসে। সময় মত না খেলে খাওয়া পাওয়া যাবে না। কিন্তু তখন যে রাজ্যের ঘুম জড়িয়ে থাকে চোখে-শরীরে! কেউ যদি খাবারটা একটু টেবিলে এনে রাখত! ঘুম ভাঙলে উঠে খেয়ে নিতাম! কিন্তু এ কাজটি কেউ করবে না। কেন করবে? এখানে কেউ কারো নয়। একজনের কাজ অন্যজনে করে না। সেদিন হঠাৎ আম্মুর ফোনে তাৎক্ষণিক বাড়ি চলে গিয়েছিলাম, এদিকে বাথরুমে একটা প্যান্ট আর শার্ট ভিজিয়ে রেখেছিলাম....বাড়ি যাওয়ার পর মনে হলো। আম্মু অসুস্থ তবু চারদিনের বেশি থাকতে পারলাম না, ঢাকা ফিরে এলাম এসে দেখি আমার প্যান্টাশার্টদুটো অদ্ভুৎ একটা জিনিস হয়ে গেছে। একদিকে মাকে ফেলে এসেছি অসুস্থ, অন্য দিকে জামাকাপড়গুলোর এই দশা...বুকটা ফেটে যাচ্ছিল। এই পৃথিবী এমন কেন? এখানকার মানুষেরা এমন কেন? ফোনে একজনকে রিকোয়েস্ট করেছিলাম...যদি একটু ধোয়ার....মানে কাউকে দিয়ে যদি একটু ম্যানেজ করা যায়....ভাইটি ঠাণ্ডা কণ্ঠে বলে মেসে কি তোমার চাকরবাকর আছে? থাকলে বলো তাকে দিয়ে দেই.... এরপর আরেকজন বোর্ডারকে রিকোয়েস্ট করলাম অন্তত মেলে রাকা যায় কি না....সে বলে আমিতো অফিসে...দেখি রাতে ফেরার পর মনে থাকলে নেড়ে দেব। খুব কৃতজ্ঞবোধ হচ্ছিল। রাতে সে ফেরে ১২টার পর, সে সময় আর ফোন দিতে সাহস হলো না, কী বলে বসে...
গরমপানি করে ধুয়ে ফেলবো ভাবলাম, কিন্তু চুলায় গ্যাস নাই। কোনওরকম ধুয়ে মেলে রাখলাম কিন্তু গন্ধ বেরুচ্ছে কেমন বোঁটকা বোঁটকা একটা গন্ধ। উপস্থিত বোর্ডাররা চিল্লাচিল্লি করতে লাগলো। কী করে রূপক? ফালাও! এইটাকি আর পড়তে পারবা? কী বড়লোকী ঢঙ। শেষে ছাদে গিয়ে নেড়ে দিয়ে এলাম। রাতে কাজে গেলাম সেখানেও একই চিত্র। কাজের একটা সিস্টেম আছে, বিপদ হতেই পারে কিন্তু সেটা জানিয়ে যেতে হবেতো!...স্যার আমি জানিয়েছিলাম! কাকে জানিয়েছ? আর জানিয়েছতো বাড়ি গিয়ে, সে জানানোয় কোনো লাভ আছে?.......শোনো চাকরি অনেক কঠিন জিনিস, এখানে মামাবাড়ির আব্দার চলে না, অনেক নিয়মকানুন ফলো করতে হয়। তোমরা বেশি শিক্ষিততো তোমাদের কোনও কথাও বলা যায় না, মাইন্ড করো। সারভাইবেল ফিটেস্ট বলে একটা কথা আছে না? তুমি ফল্ট করলে আরেকজন সে যায়গাটা দখল করবে...
ব্যাটার জ্ঞান দেয়া দেখে মেজাজ খারাপ হচ্ছিল। বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল ইংরেজি বলতে জানো না তো বলতে যাও কেন? সারভাইবেল অফ দি ফিটেস্ট...টাও ভালোভাবে বলতে পারে না। নিজেত পড়েছে ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত! কোন খড়ার যুগে একটা চাকরি আর তার পাশাপাশি একটা ব্যভসা ফেঁদে বসেছে, এখন অনেক টাকার মালিক তাই অনেক জ্ঞানেরও মালিক। কথায় কথায় উচ্চশিক্ষততের পিণ্ডি চটকায়। সব রাগ হজম করে বললাম স্যার আর এমন হবে না।
ওকে ফাইন! কাজে লেগে পড়ো।
একটিবারও জিজ্ঞেস করলো না, কেন বাড়ি গিয়েছিলে, তোমার মা কেমন আছে....
যান্ত্রিক এ শহরে মানুষের অন্তরও যান্ত্রিক!
এই কাজটাতেই তবু পড়ে আছি। দিনে এখানে সেখানে চেষ্টা করি আর রাতে কাজে যাই। মাস শেষে ৮০০০টাকা হাতে পাই। তবে কোনোদিন মিস গেলে সেদিনের বিল কেটে রাখে। এটা নিয়ম। চারদিনের বিল কেটে রেখেছে ১২শ টাকা। কাটার সময় নাকি একটু বেশিই কাটে। এটাও নাকি নিয়ম। আমরা যেহেতু চুক্তিভিত্তিক তাই নিয়মটা আরেকটু কড়া। সাপ্তাহিক ছুটি নেই। ছুটি নিলে বিল নেই। তবু কাজটা করতে হচ্ছে। ছোটভাইটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে, বাসা থেকে ওর খরচ চালানো সম্ভব নয়।...ওর খরচ আমিই দেই। সেরকমই কথা ছিল....নাকি চুক্তিই ছিল? অলিখিত চুক্তি। বাবা মা আমাকে মানুষ করবে আমি আমার ছোটদের মানুষ করবো। মাও ইদানীং টাকা চায়, ওষুধের জন্য।
বাড়িতে ছোটবোন আছে একটা ক্লাস নাইনে পড়ে। এতদ্রুত বড় হচ্ছে, চোখে লাগে। ওকে নিয়েও টনেশন করতে হয়। তার ইদানীং নতুন পোষাকের প্রতি দারুণ ঝোঁক। প্রতিমাসে তাকেও কিছু দিতে হয়। কসমেসিট অথবা ড্রেস অথবা গাইড কেনার টাকা। অতএব মাথাগরম করে চাকরি খোয়ানো যাবে না। অন্তত আরেকটা না পাওয়া পর্যন্ত। মনে মনে ভাবি বিসিএসে চান্স হয়ে গেলে আমাকে আর কে পায়। অ্যাডমিন অফিসার, যাকে এখন আমি স্যার বলি তাকে দিয়ে স্যার বলাবো। মেসের পোলাপানগুলোরে পেটপুরে মিষ্টি খাওয়াবো। বুঝিয়ে দেবো কী জিনিসটা ছিল তোমাদের কাছে তোমরা দাম দেওনাই! দেখলে...কী মহা রত্ন ছিলাম আমি!...জানি এসব কোনোদিন পূরণ হবে না। তবু ভাবতে ভালো লাগে...বুকে শক্তি পাই।

আমার আরেকটি প্রেরণার বাতিঘর ছিল জয়িতা। ওর কথা মনে হলে আমার সকল শ্রম, কষ্ট, বিষণ্নতা মিলিয়ে যেতো। সেও আজকাল আমাকে বিশ্বাস করে না। তার ধারণা আমি চাকরি পেয়ে তাকে ভুলে গেছি। যে আমাকে সব সময় শক্তি -সাহস সান্ত্বনা মনোবল জোগাতো সে উল্টো এখন আমাকে প্রেশারাইজ করে। ফোন ধরোনা কেন? একবারও কি ফোন করতে ইচ্ছে করে না, আমি কি তোমার কাছে তুচ্ছ হয়ে গেলাম!

এসব ও বলতেই পারে! জয়িতার জন্য আমি আমার প্রাণটাকে হাতের মুঠোয় করতে পারতাম, এখন কেন তাকে ভুলে গেছি?

জয়িতা দেখতে অনেক সুন্দর! ও মূলত আমার এক বন্ধুর নায়িকা ছিল। আশরাফুল ওকে আবিষ্কার করে। আমাদেরকে দেখতে নিয়ে যায়। আমি মহিউদ্দিন আর আশরাফুল একরুমে থাকতাম। কোথাও গেলেও একসাথে, একত্রে খাওয়া, বেড়ানো প্রেমকরা স-ব। আশরাফুল মেয়েটাকে পছন্দ করতো। আমরা কৌতুহলী হয়ে দেখতে গেলাম। দেখা করাটা সহজ ছিল না। জয়িতা যে কোচিংএ ক্লাস করতো আশরাফুল সে কোচিং এর টিচার। আমরা তখন থার্ড ইয়ারে। কোচিংএই পরিচয়। জয়িতা এসে আশরাফুলকে বলে স্যার আমার মডেলটেস্টের নাম্বারটা পাইনি।...আশরাফুল তার ছাত্রীল উত্তর দেয়, আর আমরা না দেখার ভান করে ওকে দেখি। অন্যমনস্কভাবে। আমার খুব বিব্রত লাগছিল। আশরাফুল স্যার মানে আমরাও স্যার! কিন্তু যে উদ্দেশ্য নিয়ে আমরা এসছি সেটি কি খাপ খায়? আমি গিয়ে বাইরে দাঁড়ালাম। আমার নাটক ভাললাগে না। রাস্তায় ঝালমুড়ি অলার কাছে দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলে নিচ্ছিলাম। মহিউদ্দিন পরিচালকের ডেস্কের সামনে বসে থাকলো আর আশরাফুল ক্লাসে ঢুকলো। জয়িতা বের হয়ে এলো। ঠিক আমার পাশে এসে মুড়ির অর্ডার দিল- মামা ৫ টাকার দেনতো। আমি বললাম এটা নিন,
কেন?
এমনভাবে কেন বলল যেন বড় কোনও অপরাধ করে ফেলেছি। বললাম আপনারতো ক্লাস আছে...
না আমার আর ক্লাস নাই।
ওকে! বলে আমি আমার প্যাকেটটা হাতে নিতে গেরাম সে সময় ছো মেরে জয়িতা নিজে নিল বলল, ক্লাস নেই তবে তাড়া আছে, থ্যাংক্যু!
আমি মুড়ির দ্বিতীয় প্যাকেটের জন্য ওয়েট করছি, জয়িতা রিকশা ডেকে উঠে গেলো।

এরপর আর সাহস হয়নি ওর সামনা-সামনি হতে। ভদ্র ছেলে, ভালো ছাত্রদের তালিকায় নাম ছিল, তাই ইচ্ছে হলেও অনেক কিছু করতে পরতাম না। ক্যাতির বিড়ম্বনা আরকি। সবাই বলবে...ছি: ছি: তুমি শেষপর্যন্ত এই কামডা করলা? তোমারে কতো ভালো মনে করতাম!....এমন কমপ্লিমেন্ট শোনার চেয়ে মরাও ভালো।

দ্বিতীয়বার দেখা আশরাফুল বার্থ-ডেতে। সেদিন ওর অনেক স্টুডেন্টই এলো। স্পট ছিল নদীর পাড়, বাঁধ। আশরাফুলের রিকোয়েস্টে একটা আবৃত্তি করলাম। যেহেতু সমবয়সী বন্ধুরাই ছিল বেশি তাই তাদের উপলক্ষ করে ও সোনা বউ কবিতাটা মনপ্রাণ ঢেলে আবৃত্তি করলাম। সেদিন কী করাণে যেন তানভীর থাকতে পারেনি, ও থাকলে আমার বারোটা বাজিয়ে দিত। ও এই কবিতাটা যে সুন্দর করে বলে!... আমার বেইল থাকত না। জয়িতার চোখেমুখে স্পষ্ট দেখলাম মুগ্ধতার ছাপ।

জয়িতার বাবা সুগারমিলের বড় কর্মকর্তা। কোচিং এর স্যারদের একদিন দাওয়াত করা হলো। আশরাফুল বলে জয়িতা নাকি আমার কথা স্পেশালি বলে দিয়েছে। কিন্তু অন্য স্যাররা ব্যাপারটা কীভাবে নেবে এটা ভেবে যেন সিদ্ধান্ত নেই।....তার মানে ও চায় না আমি সে দাওয়াতে যাই। একটা মেয়ের জন্য বন্ধুকে হার্ট করবো? কোনও দরকার নাই। আশরাফুলকে সাফ জানিয়ে দিলাম আমি যাচ্ছি না। তোমাদের স্যারদের ব্যাপার! আমি সেখানে বেমানান! যদিও আশরাফুলের চেয়ে আমার রেজাল্ট ভালো, আমিও চাইলে টিচার হতে পারতাম...
কিন্তু দাওয়াতের দিন জয়িতা একটা কাণ্ড করে বসলো। আশরাফুলের কাছ থেকে নাম্বার নিয়ে ফোন দিয়ে বলে এলেন না কেন?
আমি বললাম তুমিতো আসতে বলোনি! আমি নিজেও অবাক হলাম, এমন কথা কী করে বলে ফেললাম? ও আমাকে স্পেশালি দাওয়াত দিয়েছে এইটুকু প্রশ্রয়ে?
আমার কি বলার কথা ছিল? আপনার বন্ধু বলেনি?
হ্যা বলেছে!
ও তার মানে আমার বলার আশায় বসে ছিলেন?
ঠিক তা না, .......একটু ভয় পেলে গেলোম আমি।
ঠিক তাই। তো সেটা জানালেই পারতেন, আমি নিজে না বললে আপনি আসবেন না। পুরুষদের এইটুকু ব্যক্ত্বি থাকাই উচিৎ! যদিও দাওয়াতটা আমি করিনি, করেছেন বাবা।
এবং তিনি করেছেন আপনার টিচারদের, আমাকে নয়। ব্যাপারটা ভালো দেখাতো না।
হুম!...একটা কথা বলি?
বলেন!
ধ্যাত থাক বলব না,
কেন?
একজন মানুষ আমাকে তুমি করে বলে আবার আপনি আপনি শুরু করেছে।
আপনি কি তাকে তুমি করে বলার অনুমতি দিয়েছেন?
অনুমতির তোয়াক্কাতো সে করেনি, বেশি ভাব নেয়া হচ্ছে....
স্যরি!
ঢঙ বাদদেন, আসতে কতক্ষণ লাগবে সেটা বলেন।
গাড়ি আছে বিকাল সাড়ে চারটায়, সাড়ে পাঁচটা ৬টাতো বাজবেই।...তার চেয়ে বড় কথা কী হবে এসে?
দুপুরে খেয়েছেন?
তোমার কী ধারণা তোমাদের বাসার দাওয়াতের আসায় না খেয়ে বসে আছি?
এমন ছ্যাচড়ামার্কা কথা বলেন কেন? আপনি না কবি?
কী করে কবি হলাম? আবৃত্তি করা আর কবিতা লেখা কি এক?
ওকে সে জন্য কংক্রিটের মতো ব্যবহার করতে হবে?
শোনো, আমি যদি বলি দুপুরে খাইনি, তুমি কী ধরে নেবে?
আমার বাসার খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন, এটাই ধরে নেবো!
না তা হয়ত মনে করবে না, তবে এটা নিশ্চই মনে করবে আমি তোমার সিমপ্যাথি চাইছি। ঠিক?
ও কিছুক্ষণ চুপ থাকে, তারপর বলে আপনি দুপুরে খান বা না খান আমার কিছু করার নাই, তবে রাতের জন্য কিছু একটা পাঠিয়ে দেবো আপনার বন্ধুর কাছে, দয়া করে সেটা অন্তত খেয়ে নিয়েন। রাখি!

আমি নিজেও বুঝতে পারিনি ভেতরে ভেতরে এতো কাছাকাছি চলে গেছি। কোনও কথাবার্তা ছাড়াই যেন অনেক চেনা অনেক জানা শোনা আমাদের!

এরপর থেকে আশরাফুলের সঙ্গে আমার সম্পর্কটা ঢিলে ঢালা হয়ে গেলো। এমনকি তিন মাসের মাথায় ও রুমপর্যন্ত চেইঞ্জ করে ফেলল, এবং মহিউদ্দিন এর জন্য আমাকে দায়ী করলো। ২১২ থেকে চলে গেলো ৪১২তে। আর জয়িতার সঙ্গে আমার যোগাযোগটা নিয়মিত হয়ে উঠলো। ও ইংলিশে চান্স পেলো। চান্স পাওয়ার পর ওর মধ্যে ভিন্ন ধরণের একটা পরিবর্তন দেখলাম।আমি ওকে বলেছিলাম তোমার যদি চান্স না হয় আমি এই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে যাবো। তোমার চান্স হবেই। ও খুব ভয় পেতো, বারবার আশংকা প্রকাশ করতো যদি চান্স না পাই! আমি তখন দৃঢ়তার সাথে সাহস দিতাম। টেস্টের আগের দিন বিকেলে বাধে দেখা হয়। দেখলাম অনেক শুকিয়ে গেছে জয়িতা। আমাকে বলে একটা কথা রাখবে? আমি চেষ্টা করেছি যতোটা সম্ভব প্রস্তুতি নিতে। আমার চান্স হোক বা না হোক তুমি কিন্তু কোনও পাগলামি করবা না।
কীরকম?
তুমি কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়তে পারবা না!
এই কথা বলার জন্য ডাকছ?
হুম! আমার খুব ভয় হচ্ছে, তোমার যা মাথা গরম!
মাথা গরম কবে দেখলা?
এইতো খেপে যাচ্ছ!
আন্দাজে তোমার স্যারের কাছে শুনে একটা কিছু বলবা আর ইম খেপতেও পারব না?
স্যারের কাছে শুনিনি। তবে স্যারের সঙ্গে তুমিই বাধিয়েছ। কী হতো স্যারকে আমাদের সম্পর্কের কথা না বললে?
মানে? আমি বলেছি, না তুমি বলেছ? সবতো তুমিই করেছ....খাবার পাঠানো ফুল পাঠানো বইয়েল মধ্যে চিঠি পাঠানো। মোবাইল নাম্বার নেয়া....
আমি যা করেছি ঠিকই করেছি, ওসব না করলে স্যার আমার ঘাড়ে চেপে বসতো..এতোসব করে বোঝানোর পরও সে মানতে রাজি না, প্রায় মুখফুটে বলেই ফেলছিল....উফ! কী ভয়টাযে আমি পেয়েছিলাম!
আর আমাকে কীভাবে অপমান করেছে সেটা যদি তুমি জানতে! সব বন্ধুদের মাঝে বলে দিল ওর এক ছাত্রীর পেছনে আমি হাবার মতো ঘুরে বেড়াই আর সে আমাকে পাত্তাই দেয় না।.... তখন আমার পারসনালিটি বলে কিছু থাকে?
ও পারসনালিটি দেখাবার জন্য আমার চিঠি, আমার ডায়েরি, বই ভালোবাসার সব নিদর্শন বের করে দেখালে, তাইতো?
স্যরি আমার আসলে উপায় ছিল না। আমি ভুল বুঝেছিলাম্ আমি তোমার উপহার-উপলক্ষগুলোকে ভালোবাসা ভেবে ভুল করেছিলাম! আমি খুবই স্যরি!
জয়িতা বুঝতে পারে আমি রাগ করেছি। বলে
আজকের দিনে আর রাগ করো না। আমি কী বলতে চেয়েছি তুমি বুঝতে পারছ না। আর বুঝলেও মিন করছো ভিন্ন। কাল পরীক্ষা, আমাকে টেনশনে ফেলো না। প্লিজ!
প্লিজ!
কী?
একটু আশীর্বাদ করো।
আশীর্বাদ কি করি না?
আজ একটু ভিন্নভাবে আশীর্বাদ করো।
মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করলাম।
না হলো না।
ঠোঁট দিয়ে দেখায় এভাবে আশীর্বাদ করো।....


পরীক্ষার পর কয়েকদিন আমার নিজেরও খুব টেনশনে কাটলো সময়টা। মনে হলো নিজের চান্সের সময়ও এতো টেনশন করিনি।....
চান্সের ঘটনা নিয়েও ও একটা কাহিনী তৈরি করেছে। আশরাফুলের কাছে নাম্বার দিয়েছে ভুল। আমি যখন রেজাল্ট জানালাম তার আগেই পড়িমড়ি করে আশরাফুল রেজাল্ট বের করে এনেছে, কিন্তু জয়িতার রোল খুঁজে পেলো না। মেরিট লিস্টে না থাক অন্তত ওয়েটিং লিস্টেতো থাকবে! পরীক্ষাতো ভালো দিয়েছে....ওর পেরেশানী দেখে আমিও একটু চিন্তিত বোধ করলাম।....আমি ঠিক দেখেছিতো!.....জয়িতাকেতো জানিয়ে দিয়েছি... আবার মিলিয়ে দেখলাম! নাহ ঠিকইতো আছে। আশরাফুল কী খুঁজছে?....
কীরে কী খুজিঁস?
জয়িতার রোলটা পাচ্ছি না। মেরিটেও নাই ওয়েটিংএ ও নাই! আজব না?
বলিস কি? তোর ছাত্রীর চান্স হবে না তা কী করে হয়!
ভাব নিস না, আমার ছাত্রী আর তোর কী?
আমার কী? আমাকেতো ও পাত্তাই দেয় না।....
দেবে কেন, তোর কোনও পারসনালিটি আছে?.... নিজের ওয়েট বুঝিস না!....তুই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র, ভবিষ্যতে হয়ত ভার্সিটির টিচার হবি ,অথচ কতো নিচে নেমে গেলি একটা মেয়ের জন্য....তোকে নিয়ে আমরা গর্ব করতাম।...
কথা সত্য....আশরাফুল বন্ধু হিসেবে আমার অনেক উপকার করেছে। ওই আমাকে আবিষ্কার করেছে। আমাকে চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়েছে আমার ভেতর কী আছে...আমার পক্ষে কী করা সম্ভব! কিন্তু আজ কি সে সেই আন্তরিকতা থেকেই কথাগুলো বলছে? নাকি ফ্লার্ট করছে....শ্লেষ!
আমি বললাম- আমিতো ওকে জানতাম না, তোর অনেক পছন্দ ছিল তাই আমারও পছন্দ হয়ে গেলো। আমার বিশ্বাস ছিল তোর চয়েস খারাপ হতে পারে না।
তাই বলে নিজের ক্যারিয়ারের কথা ভূলে যাবি? তুই কি মনে করিস তোর পক্ষে আর ফার্স্টক্লাস পাওয়া সম্ভব হবে?
জানি না! তবে খারাপ লাগছে জয়িতার জন্য,
খারাপ লাগলে আর লাভ কি। তোমার জন্য পড়াশুনা করতে পারছে নাকি? রাতভর ফোনে তোমরা যে আড্ডা মারছ! পড়ছে কখন?
তুইতো বোধয় সেজন্যই রুম ছাড়লি, তাই না?
হ্যাঁ, তোর খুব সংকোচ হতো আমার সামনে কথা বলতে...তুই আপনি আপনি করে বলতি.....তাই সুযোগ করে দিলাম! তোরা যদি নিজেরা নিজেদের ভালো না বুঝিস আমি বুঝে কী লাভ!
আমার মুখফুটে একটা কথা বের হয়ে আসছিল, নিজেকে সামলে নিলাম। বললাম চল মিষ্টি খাবো।
কেন? কী উপলক্ষ?
তুই আজ অনেকদিন পর আমার সঙ্গে কথা বললি, তাই দিনটাকে সেলিব্রেট করবো।.....
তুই অনেক ফুর্তিতে আছিস, না? জয়িতার চান্স হয়নি, তোর কি কষ্ট হচ্ছে না?
হচ্ছে, হলে কী লাভ? যার যার জীবন তার তার। আমি এসব নিয়ে ভাবি না।....
তারপর জোরকরে ওকে নিয়ে গিয়ে মিষ্টি খাওয়ালাম।....
রাতে ব্যাপারটা আশরাফুল জয়িতাকে জানায়।
আমি ভেবেছিলাম ও তোমাকে সত্যিই ভালোবাসে, কিন্তু আজ দেখলাম....
জয়িতা আমাকে সব বলে দেয়, বলে আমার চান্স না হওয়াতে তুমি নাকি খুব খুশি হয়েছ?

আচ্ছা একটা ব্যাপার বুঝলাম না! ও তোমার নাম্বার খুঁজে পায়নি কেন?
আরে আমিতো স্যারকে ভুয়া নাম্বার দিয়েছিলাম।
কেন? আমি জানতাম স্যারের হাত অনেক লম্বা, সে তোমার আগে আমার রেজাল্ট জেনে যাবে, কিন্তু আমি চাইনি সু সংবাদ হোক আর দুসংবাদ হোক সংবাদটা যেন আমি তোমার কাছ থেকেই পাই...
সত্যি! তুমিতো ডেঞ্জারাস মেয়ে।
হুম! কাল আসছতো! বাসায় পার্টি হবে। আব্বু খুব খুশি। এবার আর আর কোনও ক্যাটেগরি নাই, যে কেউ অ্যালাউ!
পার্টি কোথায়?
আরে বাসায়।
নিজ বাসভবনে?
হুম!
আসবো কিন্তু কোনও প্রোটোকল বা ফর্মালিটি আছে কি না?
কী রকম?
তোমাকে কিছু দিতে টিতে হবে?
কী আংটি?
আরে ফাজিল, খালি হাতে কেউ উইশ করে? এমন একটা সুসংবাদ বয়ে আনলে...
ওসব তোমার করতে হবে না। সাহস থাকলে আংটি নিয়ে এসো....
কিন্তু সে সাহস আমার হয়নি।
আমি বললাম- আংটি না হোক পাছুঁয়ে সালাম টালাম কিছু করতে হবে?
এমন স্বপ্ন আমাকে দেখিও না! প্লিজ! আমার সবকিছুই এখন স্বপ্ন বলে মনে হয়।...আমি জানি না ভবিষ্যত কী হবে, তবে....থাক আজ আর কোনও আশংকার কথা বলবো না। কাল এসো কিন্তু। পরিচয়টা হয়ে যাক।

পরিচয় পর্বে ও ওর বাবার কানে দেয়ার জন্য আমার রেজাল্টটাকে হাইলাইট করে। বলে আপনারাতো একই সঙ্গে, সিরিয়ালে কে আছেন?
আশরাফুল বলে আমরা তিনজনই সিরিয়ালে আছি।
কার সিরিয়াল কতো?
আশরাফুল বলতে বাধ্য হয় সে সপ্তম আর আমি থার্ড।...মহিউদ্দিন ১০ম।
মেয়েটা খুটিয়ে খুটিয়ে এসএসসি এইচএসসির রেজাল্টটাও জানায় তারা বাবাকে।
ভালোইতো! থ্রি ফার্স্টক্লাস হলেতো বিশ্ববিদ্যালয়ের টিচার হতে পারবেন।...মহিউদ্দিন জোশের সঙ্গে বলে ফেলল আমার কথা, ওতো টিচার হবেই....
মনে হলো জয়িতার বাবা কিছুটা অ্যামব্রেসড। মেয়েটা ভালো টেকনিক জানে।
তাহলেতো এখন থেকেই আপনাকে স্যার বলা শুরু করতে হয়....
এই নাটক আমার ভালো লাগছিল না, পাছে ওর বাবা কিছু ধরে ফেলে। লোকটা কতো বিশ্বাস নিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করাচ্ছে...

কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই ওর এমন পরিবর্তন হলো কেমন উড়ো উড়ো ভাব। হেয়ালী হেয়ালী কথা! আমি জানতে চাই ব্যাপারকি? ও কিছুই বলে না। মনে হয় যেন আরও উপেক্ষা করছে।
কেন এই উপেক্ষা? ভার্সিটিতে চান্স হওয়ায় কি পাল্টে গেলো? নাকি বাবা মার দিক থেকে কোনও নেগেটিভ সিগন্যাল পেয়েছে? তারা হয়ত বলে দিয়েছে মা তোমার পছন্দ আমাদের খাটছে না...

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.