সময়টা ফিরে আসে গোলাকার বৃত্তের মতো
সময়টা ফিরে আসে গোলাকার বৃত্তের মতো একই সারিতে। বহুদিন পর এবার ক্যাম্পাসে গেলাম। আমার পুরনো সেই স্মৃতিময় ক্যাম্পাস। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে বিদায় নিয়েছি এরপর আর যাওয়া হয়নি ওইদিকে। এবার এক উসিলায় সুযোগ ঘটলো। মাহবুব মামার বিয়ে উপলক্ষে। মেয়েটা ইউনিভার্সিটির ছাত্রী। তবে গ্রামের বাড়ি আলমডাঙা। বেশ বেগ পেত হয়েছে বাড়ি যেতে। আমাদের কারওই পছন্দ হয়নি ওর শ্বশুরবাড়ি। এতে অবশ্য ওর কিছু যায় আসে না। ও বউ পেয়ে এমনই মাতাল হয়ে গেছে যে ওর ছোটভাই, ভাগ্নেদের ওর শ্বশুরপক্ষ যেভাবে ইগনর করলো এসবের কিছুই ওর নজর কাড়ল না। অবশ্য এর কোনওটাই আমার গায়ে লাগেনি। আমি মূলত গেছি আমার স্মৃতিময় ক্যাম্পাসের উদ্দেশ্যে। আর তাই বেশিরভাগ সময়টা কাটিয়েছি ওদের সঙ্গে। মাহবুবের শ্বশুরবাড়ি থেকে সরাসরি ক্যাম্পাসে গেলাম। ভাইয়া শাকিল মামা ওবায়দুল ভাইকে একসঙ্গে রেখে আমি গেলাম মনিরের রুমে। ওর রুমও খালি। বেশকিছু কথা আছে শেষ করতে হবে। মনির অনেককাল ধরে ভুল বুঝে আছে আমাকে। ভুল ভাঙাতে হবে। রাত ২টা আড়াইটা পর্যন্ত কথা চলল কিন্তু ঘুম এলো না।জাবিরের জন্য ভেতরটা ছটফট করছিল। ওকে সঙ্গে নিতে পারলে ভালো হতো। ওকে মানে ওর মাকেও।
সকালে দাওয়াত ছিল রুহুল আমিন স্যারের বাসায়। তারেকের বোন বিরিয়ানী রান্না করে খাওয়ালো। এরপর শিবির সভাপতির দাওয়াত রক্ষা করে যোগ দিলাম মুক্তবাংলা সাহিত্যসভার বিশেষ বৈঠকে। বৈঠকে টুম্পা বিদায় নিল, ওর স্থান দখল করলো চঞ্চল। বিকেলে বেরিয়ে পড়লাম কুষ্টিয়ার উদ্দেশ্যে। দলছুট হয়ে গেলাম রেজাউল করিম স্যারের সঙ্গে সাক্ষাত করতে। ওরা থেকে গেলো কুষ্টিয়া আর আমি আর মনির চলে এলাম ক্যাম্পাসে। টুম্পা সকালে চলে যাবে ওকে বিদায় জানাতে গেলাম ওর হলের সামনে। সেই পুরনো দিনের ভেতরবাইরে কথা হলো। ঠিক এমন করে এক রাতে মনিরকে তুলে দিয়েছিলাম টুম্পার হাতে। বলেছিলাম এটা তোমার ছোটভাই, যত্ন নিও। খেয়াল করো। অল্পদিনেই দুজন প্রমাণ করলো আমার সিলেকশন ভুল ছিল না। মনির সত্যিই একটা দিদি পেয়েছে আর টুম্পাও একটা ভাই পেয়েছে।যতটুকু আপন হওয়া দরকার আর যতটুকু দূরত্ব রাখা দরকার সবটাই রক্ষা করে চলেছে ওরা। আমি গর্বিত বোধ করি। কিন্তু ৫বছর পর ঠিক একই সমিকরণে টুম্পার বিদায়। মনির হয়ত কেঁদে ফেলত, আমি পরিবেশটাকে সেদিকে যেতে দেইনি। টুম্পাই মনে করিয়ে দিল ঠিক এভাবেই একদিন রাতের গাড়িতে ওদের পরিচয়।
আমি দুজনকেই কৃতজ্ঞতা জানালাম। এতোদিন পর্যন্ত একটা সম্পর্ক ঠিক একই বিন্দুতে রক্ষা করে চলা ভীষণ কষ্ট। সাধারণত যা হয় প্রথম একে অপরের প্রতি কিছুটা ভালোবাসা, কিছুটা শ্রদ্ধাবোধ পোষণ করে এরপর কোনও না কোনও কারণে একে অপরকে ভুল বোঝে, তারপর ভেঙে খান খান হয়ে যায়। কেউ প্রথমে বন্ধুত্ব পরে প্রেম তারও পরে ছাড়াছাড়ি। প্রকৃত বন্ধুত্ব বা ভাইবোনের সম্পর্কে বেশি দিন খুশি থাকতে চায় না স্বার্থপর মানুষেরা। ছোটবোন, ছোটভাই, বন্ধু ইত্যাদির আড়ালে মুখোশধারীরা লুকিয়ে রাখে অন্য সম্পর্কের খঞ্জর। মনির টুম্পা তা করেনি। যদি তেমন কিছু হতো তার জন্য নিজেকে দায়ী মনে হতো। হয়নি টাকা পয়সা নিয়ে কোনও লেনদেনগত দু:সম্পর্ক। তবে টুম্পা এবং চঞ্চলের সম্পর্কটা বন্ধুত্বের বাইরেও অনেকটা বিস্তৃত হয়ে গেছে। কিন্তু ধর্ম ওদের আলাদা করে রেখেছে। মানুষের মূল পরিচয় ইন্ডিকেট করে ধর্ম। ধর্ম না থাকলে তার কীইবা থাকে?শৃঙ্খলা রক্ষা করে ধর্ম। শৃঙ্খলা বিহীন চেতনা শুধু অধার্মিক নয় নিতান্তই বন্যতা। পশুত্ব। হিন্দু ধর্মে বিয়ের একধরনের পদ্ধতি আছে। আছে মুসলমান ধর্মেও যে যে ধর্মের সে সেটা রক্ষা করে চলে। যে কোনওটাই রক্ষা করে না সেটাকে আমরা বলি অযাচার। যার তার সঙ্গে যখন তখন যেভাবে খুশি দৈহিক সম্পর্ক তৈরির ফল কখনও ভালো হয় না। ধর্মের এসব নিয়শৃঙ্খলা মানুষের ভালোর জন্যই করা। এর বাইরে গিয়ে মানুষ সুখ পেতে পারে না, শান্তি পেতে পারে না। নিয়ম হচ্ছে আমার স্ত্রীর পেটে যে সন্তান আসবে সে আমার। যদি বিয়েপ্রথা বাতিল হয় বাতিল হবে স্ত্রী চুক্তি। তখন কী দাঁড়াবে জগৎসংসারের? আমার স্ত্রী আমার। সে অন্য কারও বিছানায় যতে পারবে না, এটি আইন নিষেধ করেনি, করেছে ধর্ম। এটি মান্য না করলে কীভাবে গড়ে উঠবে পরিবার? কোনও না কোনও ধর্মের অনুশাসন মানুষকে মেনে চলতে হয়। চঞ্চল অনেক কেয়ারী একটা ছেলে। টুম্পার প্রতি ওর ভালোবাসাটা টের পেয়েছিলাম শুরুতেই। তখন অবশ্য ও টুম্পার ফ্যান ছিল। এরপর সম্পর্কটা গাঢ় হতে হতে ধর্মের শেকল ছিন্ন করে গভীরতার দিকে এগিয়ে যায়। চঞ্চলের সাধ্য নেই হিন্দু হবার। কারণ হিন্দু হতে হয় জন্মগতভাবে। কিন্তু টুম্পার সুযোগ আছে মুসলমান হবার। কিন্তু তাতে ওর ছাড়তে হবে এতোদিনের এতোপ্রিয় সব আপনজনকে। মাকে ছাড়তে পারবে না টুম্পা। পারবে না বাবা কিংবা দিদি-ছোটবোনের আদর ভালোবাসা হারাতে। তাহলে কী পরিণতি এ সম্পর্কের? শুধু বন্ধুত্বে কি এটি স্থায়ী হতে পারত না? ওরা ভাবছে পারত না। কারণ দুজনের মাঝেই অন্য কেউ আসবে, আর এই অন্যজনের কাছে টেন্ডার হয়ে যাবে এদের ভালোবাসা। ওরা কেন এভাবে ভাবছে? মনিরতো জানে চঞ্চল-টুম্পার ভেতরকার সম্পর্কটা কিন্তু ও কি তাতে আঘাত পায়? ও বরং দারুণ উৎফুল্ল।
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন