হস্তরেখাবিদ
হস্তরেখাবিদ
-মামুন মাহফুজ
আমার বাবার চরিত্র ছিল অনেকটা মহামানবদের মতো। সাধারণ জীবন-যাপন, সব মানুষকে একই কাতারে ভাবা, সম্মান দেওয়া, উঁচু নিচু ভেদ না করা ছিল তার আদর্শ। মাহবুব কাকা ছিলেন এক অর্থে বাবার কলিগ। কিন্তু উভয়ের স্ট্যাটাস এক নয়। মাহবুব কাকা ছিলেন পিয়ন ক্লাসের। কথাটা বলতে আমার খুব খারাপ লাগছে, মনে হচ্ছে আমার বাবা এটা শুনতে পাচ্ছে, এবং ভীষণ হতাশ হয়ে বলছে কী শেখালাম সারাজীবন! সন্তানদের! তারচেয়ে এভাবে বলি! মাহবুব কাকা আর আমার বাবা একই অফিসে চাকরি করেন। কাকাদের বাড়ি ছিল গ্রামে, একেবারে প্রত্যন্ত গ্রামে। গ্রামের নাম বোধয় কুচিয়ামোড়া। একবার ক্যাম্পাস থেকে কাকার বাসায় বেড়াতে গেলাম কাকার সাথেই; সাইকেলে চড়ে। যেতে যেতে রাত হয়ে গিয়েছিল, তবু একজন দু’জনের কানকরে গ্রামে জানাজানি হয়ে গেলো- মিতাদের বাসায় একটা ছেলে এসছে, দেখতে আমীর খানের মতো। রাতে দুয়েকজনের কানাঘুষা আর ফুচকিমারা টের পেলেও ব্যাপারটা আ’মল দেইনি। কিন্তু ভোর হতেই অল্প বয়সী এবং উঠতি বয়সী মেয়েদের ভিড় বেড়ে গেলো। গ্রামের মানুষ সুন্দর হয় না। রোদে পুড়ে সব কালো হয়ে যায় এমন একটা ধারণা আমরাও ছিল। কিন্তু মিতা-রত্নার বান্ধবীদের অনেককেই দেখলাম অনেক সুন্দর! রীতিমত আকর্ষণীয়। ওদের একজন শাবনূর। দেখতে চিত্র নায়ীকা শাবনূরের মতো! আমি দেখার আগ্রহ প্রকাশ করতেই মেয়েটাকে আমার সামনে হাজির করা হলো। আমি বসে আছি মাটির একটা ঘরে। চারিদিকে মাটির দেয়াল। এমন ঘরে রাত্রিযাপন হয়েছে এইই প্রথম। গ্রামের ঘুটঘুটে সেই অন্ধকারও এমনভাবে উপভোগ করিনি এর আগে। সকালের দৃশ্যটাও তাই অনেক মনোমুগ্ধকর! গ্রামের মানুষজন; বেশিরভাগই মিতাদের আত্মীয়। যারা এতোদিন শুধু আমাদের গল্পই শুনেছে, দেখেনি, দেখার প্রবল আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করেছে। এদের কেউ কেউ আমার মায়ের একান্ত ভক্ত! মা একবার এসছিলেন, সে সময় অনেক ভক্তি কুড়িয়েছেন গ্রামের এসব সহজ-সরল মানুষের কাছ থেকে। তারই ঋণ এখন আমাকে শুধতে হবে। একটু বয়স্ক মহিলাদের দেখে আমি একটু বিব্রত বোধ করছি যদিও তবে বিরক্ত হচ্ছি না। এদের কারও কারও হাতে আমার জন্য নানান খাবার আইটেম। ফল এবং পীঠা। অনেকে আবার ব্যাগ্র হয়ে জানতে চায় আমি কী পছন্দ করি? আমি জানি এসব ভালোবাসা আমার মায়ের জন্য এবং আমার বাবার জন্য। আমি জানি না আমার বাবা মা এদের জন্য কী এমন করেছিল! মিতা-রত্নার ছোটবোন সুমাইয়া এবং অনেক সাধের-স্বপ্নের ছোটভাইটার নামও রেখেছেন আমার বাবা মা। এবং এটাও গ্রামের সবাই জানে।
শাবনূর আমার বসে থাকা চৌকিটাতে এসে বসলো অনেক অনুরোধের পর। সত্যিই মেয়েটা অনেক সুন্দর! একটা বিমোহিত আকর্ষণ-দ্যুতি যেন ছড়িয়ে পড়ে ওর শরীরের চারপাশ দিয়ে। আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ওর হাতটা একটু ছুয়েঁ দেখি! কিন্তু সঙ্কোচ লজ্জা ভয়ে সেটা সম্ভব হচ্ছিল না।
সকালের ফর্ম্যাল নাস্তার সময় সবাই সরে গেলো। নাস্তাবিরতি! সে সময় রত্নার কাছে অনেক কিছু জানলাম গ্রামের! সহজ-সরল মানুষগুলোকে কীভাবে ভণ্ড পীর-ফকির আর খনকার-কবিরাজরা ঠকাচ্ছে। রত্না আমার কাছেও জানতে চায় হাতদেখে সবকিছু বলা যায় কি না!
আমি বলি- না, হাতে সবকিছু লেখা থাকে না। এসব লোকঠকানো ভণ্ডামি!
রত্না মানতে চায় না, বলে কিন্তু ওরা যা যা বলে সব ঠিক ঠিক লেগে যায়।
আমি বললাম অনুমান করে এমন কথা আমরাও বলেতে পারি।
রত্না যেন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়, আমার হাত দেখে বলেনতো!
অনেক পীড়াপীড়িতে শেষে খেতে খেতে বললাম হাতটা এখানে মেলে রাখ! দেখি! আমি বলতে শুরু করলাম!
তোরতো বিদ্যা রেখার অবস্থা খুব খারাপ! পড়ায় একদম মন নেই!
ও চমকে যায়, সায় দেয় ওর সত্যি পড়তে মনে চায় না।
একটা ছেলে খুব ডিস্টার্ব করে, প্রেমের অফার দেয়, কিন্তু তুই বাবা-মার মনে কষ্ট দিতে চাস না। এটা বলায় ও রীতিমত আকাশ থেকে পড়লো!
ভাইয়া কীভাবে বললেন?
আমি ওর বিশ্বাসের মাত্রা পুরোপুরি জয় করে ফেলেছি।
দেখি, আয়ু রেখাটা দেখি! ছোটবেলা তোর বড় একটা ফাড়া গেছে, তুইতো বলতে পারবি না, কাকীকে জিজ্ঞেস করতে হবে।
না না আমি জানি, আমি মরে যেতে লাগছিলাম। পানিতে ডুবে।
ঘটনাটা আমার আগেরই জানা। তখন ওরা কলোনীতে থাকত। আমাদের বাসার যে রুমটা দারোয়ানের জন্য বরাদ্দ ছিল সে রুমে ওরা থাকত। এরপর আর ওকে বিশ্বাস করানো কঠিন আমি হস্তরেখাবিদ নয়। আরেকটু নাটক করে ওর বিশ্বাস নিয়ে খেললাম!
তুই কি খুব দুশ্চিন্তা করিস? খাওয়া দাওয়ায় মন বসে না, খুব সাজতে ইচ্ছে করে?
ও তাতেও সায় দেয়। আমি জানি না এসব কোন রেখায় লেখা থাকে। যদিওবা কয়টা রেখা চিনতাম! তাতে এসব কোনওদিনই বলা যেতো না।
কিছুক্ষণের মধ্যে সরা গ্রামে জানাজানি হয়ে গেলো আমি হাত দেখতে জানি। ব্যাস আমার বারোটা বেজে গেলো! যতোই ওয়াজ করি এসব ঠিক না, এসব মিথ্যা, কিন্তু কে শোনে কার কথা। সবাই এসে তাদের হাতটা আমাকে পেতে দিচ্ছে। বয়স্ক মহিলারাও আছে এ সাড়িতে। নিজেই নিজের বিপদ ডেকে আনলাম। তবে মজা হলো অনেক সুন্দরী তরুনীদের হাত ধরতে পারলাম ইচ্ছে মতো। বিশেষ করে সেই শাবনূরের! শাবনূর সম্পর্কে পুরো ভবিষ্যদ্বাণী ওর সামনে করলাম না। রত্নাকে আলাদা ডেকে বললাম ওকে একটু সাবধানে রাখতে হবে। ওর আয়ু রেখা খুবই দূর্বল। আমার ধারণা ও দুই মাস অথবা দুই বছরের মধ্যে আত্মহত্যা করবে। কিন্তু এ কথা ওকে কোনওভাবেই জানানো যাবে না। একটু সাবধানে চোখে চোখে রাখতে হবে।
রত্নাকে কসম করালাম ও কোনওভাবেই একথা কাউকে বলবে না। শুধু ও যা চায় ওকে যেন তাই করতে দেয়া হয়, ওর অনিচ্ছায় যেন ওকে বিয়ে না দেয়া হয়। কেউ দুর্ব্যবহার যেন না করে, কয়দিন আর বাঁচবে বলাতো যায় না, শুধু শুধু একটা মেয়েকে মনে কষ্ট দিয়ে কী লাভ!
আমি জানি না কথাটা আমি কী কারণে বলেছিলাম! নিছক মজা করবার জন্য কি না মনে নেই। তবে মেয়েটার মধ্যে অসম্ভবরকম একটা নির্লিপ্ততা টের পেয়েছিলাম! ওর হাত ছুয়েঁ আমার মনে হচ্ছিল আমি কোনও পৃথিবীর মানুষের হাত ধরে নেই, অন্য কোনও জীবের হাত ধরেছি। হাতটা ছেড়ে দেবার পরও অনুভুতিটা লেগে ছিল ভেতরে। এ পর্যন্ত হাততো কম ধরলাম না। সুন্দর অসুন্দর তরুণী-বয়স্ক মিলিয়ে শ’য়ের কাছাকাছিতো হবেই! এমনতো হয়নি।
দুপুরে এক পীরের মাজার দেখতে গেলাম। সম্ভবত ঘোড়াপীরের। না জানি ন্যাংটা পীর! শুনলাম নানান কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিশ্বাস-ধর্মের কথা। বিকেলে বিদায় নিতে চাইলাম। কেউ আমাকে আসতে দেবে না, সবাই এসে ভিড় করে , সবার অনুরোধ আজকের রাতটা যেন থেকে যাই। আমি থাকলাম না, তবে একটা মোবাইল নাম্বার নিলাম। রত্নার চাচাতো ভাই থাকে আমেরিকা। ডিভি ভিসায় গেছে। ওদের মোবাইল আছে। রুমার কাছে থাকে মেবাইলটা। ওর কাছে চাইলে যখন ইচ্ছা ওদের পাওয়া যাবে। তবে রুমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। সব ঠিকঠাক। রুমার বিয়ের কথাবার্তা শুনে মিতার মায়েরও তড়পানী শুরু হয়েছে। একই বয়সী মিতার বিয়েতো হলো না! তিনিও ছেলে খুঁজছেন। এর জন্যই আরও বেশি তাড়া অনুভব করলাম ফেরার। গ্রামের মানুষের মতিগতি বোঝা কঠিন। কী ভেবে বসে কে জানে। কে কী মনে করে কে জানে? আর মাহবুব কাকারই ইচ্ছে কী কে জানে? তারা হয়ত চান....
এসব ভেবে বিকেলেই রওনা হলাম। রাস্তা পর্যন্ত গ্রামের মানুষের বিশাল মিছিল এলো আমার পেছন পেছন। রত্না আর শাবনূর এগিয়ে এলো একবারে কাছাকাছি। শাবনূরের হাতে পেয়ারা-
আপনি পেয়ারা খেতে চেয়েছিলেন
খেয়েছিতো!
লুডু খেলার কথা ছিল
আবার যখন আসবো তখন!
কবে আসবেন?
মিতার বিয়েতে। হয়ত। রত্না মিতার বিয়েতে আমাকে দাওয়াত দিবি কিন্তু! নাম্বার দিয়ে গেলাম, হারাবি না।
আমি মনে মনে চাইছিলাম, শাবনূরও জানুক আমি নাম্বার দিয়ে গেছি। একবার হলেও ফোন করুক।
হলে পৌছেঁ কয়েকটা দিন আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করলাম, শাবনূর ফোন করবে। কিন্তু করল না। হয়ত রুমাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। হয়ত উঠতি ধনীরা সবাইকে একটু এড়িয়ে চলতে চায়। বালি-কাটা শ্রমিক ছিল রুমার বাবা। ডিভিতে ছেলে বিদেশ যাবার পর গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর এবং বড় পাকা বাড়িটি এখন তাদের। অন্যান্য ফার্নিচারে থই থই করছে ঘর। বিদ্যুত ফ্রিজ বিদেশী মালামালে ঠাসা ঘর। উজ্জল কালো বর্ণের রুমাও দেখতে অনেকখানি চেইঞ্জ। কথাবার্তায় অনেক পরিবর্তন!.....
কোন মন্তব্য নেই
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন